সুন্দরবনে বাঘ মানুষ খায় কেন?

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ১৩:১১

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ১৯৯০ সাল হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম সুন্দরবনে মারাত্বক বাঘের আক্রমণ চলে যাতে প্রায় ১৫০০ মানুষ নিহত হয় ১৫০০ নারী বাঘ বিধবা হয় এই সমস্ত বাঘ বিধবারা এখনো মানুষের দ্বারে দ্বারে স্বামী হারা কলঙ্কের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরকারিভাবে বা বেসরকারি ভাবে তাদের বাস স্থান বা কোনো কর্ম সংস্থান এর ব্যাবস্থা হয়নি।কেন সুন্দরবনের কিছু কিছু বাঘ মানুষ শিকার করে তা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা চালিয়েছেন প্রকৃতিবিদ ও প্রাণিবিজ্ঞানীরা। এসেছেন বিদেশিরাও। তাদের সেসব অনুসন্ধান নিয়ে লেখা বই ও মন্তব্য দিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম

গত ১ অক্টোবর দেশের প্রথম সারির প্রায় সব সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের জেলে শিপার হাওলাদারের। এক দিন সকালে বাড়ির পাশে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান তিনি। তবে সারা দিনেও বাড়ি ফিরে না এলে পরিবারের লোকজন শিপারের খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। কয়েক দিন খুঁজেও তাকে না পেয়ে পরিবারের সদস্যসহ অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে বনে তল্লাশি চালায়। ওইদিন সকাল ৮টার দিকে বনের তুলাতলায় শিপারের মাথা ও রক্তমাখা প্যান্ট পান তারা।

স্থানীয় ইউপি সদস্য জানান, যেখান থেকে শিপারের প্যান্ট ও মাথা উদ্ধার করা হয়েছে, তার আশপাশে বাঘের পায়ের অসংখ্য ছাপ পাওয়া গেছে। সবার ধারণা, তাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। কারণ সেখানে শিপারের হাত-পাসহ শরীরের অন্যান্য অংশ পাওয়া যায়নি।

খবরটি অনেকেরই নজরে আসে। একসময় বাঘ সংরক্ষণে যুক্ত থাকা ইসমা আজম রেজুও এ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান ওই এলাকার বাসিন্দা এবং পর্যটকদের। তিনি সতর্কতা হিসেবে ‘ধনসাগর ও আশপাশের বনাঞ্চল জয়মনির থেকে শরণখোলা’ এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন।

তখন তার সঙ্গে কথা হয় বাঘের এই মানুষ খাওয়ার ‘স্বভাব’ নিয়ে। যদিও রেজু একে বাঘের স্বভাব বলতে রাজি নন। তার মন্তব্য, সুন্দরবনের এ অঞ্চলে বাঘ ও মানুষ বিভিন্ন সময় কাছাকাছি চলে আসে। ফলে বাঘের সহজ শিকারে পরিণত হয় মানুষ। অন্য এলাকার বাঘ সহজে মানুষের দেখা পায় না। যে কারণে তাদের ক্ষেত্রে মানুষ খাওয়ার ঘটনাও ঘটে না।

এই প্রতিবেদককে বলেন , ‘সহজ কথায় বলি যে বাঘ প্রিডেটর। তবে বাঘকে আমি হিংস্র মনে করি না। কারণ মানুষসহ সব প্রাণী শিকার করে খায়। আবার বাঘসহ যেকোনো প্রাণী মানুষকে ভয় করে। কিন্তু যখন কোনো মানুষ বাঘের সামনে চলে আসে তখন হয়তো বাঘ তাকে আক্রমণ করে বসে। বাঘ যদি জানতে পারে যে মানুষ তার খাওয়ার যোগ্য প্রাণী, তাহলে সে তখন মানুষের ওপর হামলা করে। আবার যে বাঘ মানুষ খায়, সে যে অন্য প্রাণী শিকার করে না তা কিন্তু না।’

তার মতে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গার বাঘেরও মানুষ খাওয়ার রেকর্ড আছে। এটা মুখরোচক কথা যে সুন্দরবনের বাঘ মানুষ খায়। জিম করবেটের কাহিনিতেও আমরা দেখেছি ভারতের অনেক বনে চিতাবাঘ মানুষ খেয়েছিল। রাশিয়ার আমুর বাঘ বিশাল টেরিটরি নিয়ে অবস্থান করে। কিন্তু তার সঙ্গে মানুষের দেখা হয় না। হলে হয়তো সেও মানুষখেকো হয়ে উঠত।

সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘ নিয়ে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদরা গবেষণা করেছেন। তারা বিভিন্ন বইও লিখেছেন। তাদের একজন সাই মনটোগমেরি। এই জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন গবেষকের একটি বইয়ের নাম ‘স্পেল অব দ্য টাইগার : দ্য ম্যান ইটারস অব সুন্দরবন’। সেখানে লেখক বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য এলাকার বাঘের ক্ষেত্রে কদাচিৎ মানুষ খাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সুন্দরবনের বাঘের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা অনেক। মনটোগমেরি জানাচ্ছেন, শতবর্ষ ধরে সুন্দরবনের বাঘের খাবারের তালিকায় আছে মানুষ।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে সহস্রাধিক মানুষ বাঘের হানায় প্রাণ দিয়েছে। যাদের কেউ কেউ তাদের খাবারে পরিণত হয়েছে। বাঘের হাতে নিহত পুরুষের স্ত্রীকে বলা হয় ‘বাঘ-বিধবা’। সুন্দরবন এলাকায় এমন কুসংস্কারও রয়েছে, স্বামী মাছ শিকার বা মধু আহরণে গেলে স্ত্রীকে ব্রত পালন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী ব্যবহার না করা, ভাজা-পোড়া না খাওয়া ইত্যাদি।

মনটোগমেরি বলছেন, পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় প্রাণী এই সুন্দরবনের বাঘ। যার সম্পর্কে প্রাণিবিজ্ঞানে খুব কমই বলা আছে। এ বাঘের মানুষ শিকারের কিছু কারণও তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন তার বইয়ে উল্লেখ আছে জার্মান জীববিজ্ঞানী হুবার্ট হেনড্রিচসের একটি গবেষণার কথা। যিনি মনে করতেন যে এ এলাকার বাঘ হিংস্র হওয়ার কারণ সুন্দরবনের লবণাক্ত পানি। সুন্দরবনে বৃষ্টির জমা পানি ছাড়া আর সব পানি লবণাক্ত, যা বাঘের যকৃৎ ও কিডনিকে আক্রান্ত করে। এতে বাঘের অভ্যন্তরে অস্বস্তি তৈরি হয়, যা তাকে হিংস্র করে তোলে। হুবার্ট যে জরিপ চালিয়েছিলেন, তাতে দেখা যায় বাঘ সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছে যেসব স্থানে, যার কাছাকাছি লবণাক্ত পানির উপস্থিতি আছে। অবশ্য তিনি গবেষণাটি শেষ করার আগেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তাকে কাজ অসমাপ্ত রেখেই বাংলাদেশ ছাড়তে হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান অবশ্য মনে করেন, লবণাক্ততার সঙ্গে বাঘের হিংস্র হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত না। একই কথা বলা আছে মনটোগমেরির বইয়েও। তবে তিনি বাঘের মানুষ খাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আরও একটি বিষয়। তিনি বলছেন, ধারণা করা হয় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত গঙ্গার পানি সুন্দরবন অঞ্চল দিয়েও প্রবাহিত হতো। তখন সেই পানিপ্রবাহে ভেসে কলকাতার বিভিন্ন ঘাটে পোড়ানো মড়ার অসম্পূর্ণ দেহাবশেষ সুন্দরবনে চলে আসত। এখানকার বাঘ সেগুলো খেয়ে থাকতে পারে। এভাবে মানুষের মাংসের স্বাদ পেতে শুরু করে সুন্দরবনের রাজা বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

এ বিষয়টি বিবেচ্য বলে মনে করছেন মনিরুল খান এবং ইসমা আজম রেজুও। রেজু আরও যোগ করেন, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের খালগুলোতে মানুষের লাশ ভেসে আসতে পারে। সেখান থেকেও বাঘ মানুষের মাংস খেয়ে থাকতে পারে।

মনটোগমেরির বইয়ে আরও একটি কারণের কথা বলা আছে। সেটি হলো, সুন্দরবনের জেলেরা মাছ ধরার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে জাল পেতে রাখতেন। সেই মাছ খেতে বাঘ আসত। তখন বাঘে ও মানুষে কোনো একভাবে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে প্রাণ হারানো মানুষকে ক্ষুধার্ত বাঘ খেতে শুরু করে।

মনিরুল খান যদিও বলছেন, ক্ষুধার সঙ্গে বাঘের মানুষ খাওয়ার সম্পর্ক নেই। যে বাঘ মানুষ খায়, সে-ই শুধু খাবে। যে বাঘের স্বভাব নয় মানুষ খাওয়া, সে মানুষকে হত্যা করলেও মাংস খাবে না। মনিরুল খান বাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার জন্য মনটোগমেরি প্রস্তাবিত কোনো কারণই প্রমাণিত নয় বলে জানান।

তিনি বলেছেন, অন্যান্য প্রাণী যেমন কুমির, চিতাবাঘ মানুষকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। তবে কুমিরকে মানুষখেকো বলা যায় না। সুন্দরবনের কিছু কিছু বাঘকে মানুষখোকো বলা যায়, তবে সব বাঘকে নয়। যে বাঘ মানুষখেকো সে যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিন শিকারের জন্য মানুষ খুঁজবে।

কিন্তু কবে থেকে শুরু হয়েছে এবং প্রথম কবে বাঘ মানুষ খাওয়া শুরু করেছে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলার সুযোগ নেই। যেহেতু এ বনে সুস্থ বাঘও মানুষ খায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে এখানকার কিছু কিছু বাঘের মানুষ খাওয়া তাদের স্বাভাবিক আচরণে চলে এসেছে।

ইউটিউবে ‘দি অ্যানিমেল এরিয়া’ নামে একটি চ্যানেলে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের বাঘদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচারিত হয়। তাতে দেখা যায় মানুষখেকো বাঘ মানুষ শিকারের জন্য গ্রামে ঢুকে পড়ে। মানুষ শুয়ে আছে এমন ঘরের দেয়ালে হামলা করে। বিশ্বখ্যাত বাঘ শিকারি ও লেখক জিম করবেটের কাহিনিতেও দেখা যায় একটি বাঘ মানুষখেকো হয়ে ওঠে। মানুষ খাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে যায়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা করে। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে ওই এলাকার মানুষ জিম করবেটকে ভাড়া করে নিয়ে আসে। তিনি দিনের পর দিন ওই বাঘের গতিবিধি ও স্বভাব পর্যবেক্ষণ করে ফাঁদে ফেলে সেই বাঘ হত্যা করেন। হত্যা না করলে সেই বাঘের হাত থেকে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে না। জিম করবেটের কাহিনি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পায়। বাঘের রহস্যজনক আচরণ, হিংস্রতা এবং মানুষের মাংসের লোভে তার দুঃসাহসের কাহিনিগুলো যুগের পর যুগ পাঠকের আগ্রহের তালিকায় আছে।

মনটোগমেরি বলছেন, বাঘের জন্য মানুষ হলো সহজ শিকার। কারণ শারীরিকভাবে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় দুর্বল। মানুষের শরীরে শক্ত চামড়া বা পশম নেই। বরং তা নরম। বাঘের পক্ষে তাই মানুষ খাওয়া সহজ।

মনিরুল খানের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায়, অন্যান্য অঞ্চলে অসুস্থ, আহত বা বয়স্ক বাঘ মানুষ খেয়ে থাকে। তবে সুন্দরবনে সুস্থ এবং তরুণ বাঘও মানুষ খেয়ে থাকে। এ থেকে বোঝা যায় এসব বাঘ আচরণগতভাবে মানুষ খাওয়ার বিষয়টি রপ্ত করেছে, যা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তবে এই স্বভাব ধারাবাহিক বা জিনগত কি নাÑ এর কোনো প্রমাণ নেই।

তিনি বলেন, যে বাঘ মানুষ খায়নি তার কাছে মানুষ অদ্ভুত প্রাণী। বিঘ্ন না ঘটালে সাধারণ বাঘ মানুষকে আক্রমণ করবে না। আক্রমণ করে আহত বা মেরে ফেললেও মাংস খাবে না। কিন্তু মানুষখেকো বাঘের আচরণ এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। তারা মানুষকে শিকারযোগ্য প্রাণী মনে করে। তার খাদ্যতালিকায় থাকা একটি খাবারের নাম মানুষ।

জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবনে আগের তুলনায় বাঘের হাতে মানুষের প্রাণহানি কমেছে বিভিন্ন কারণে। বাঘের সংখ্যা যেমন কমেছে, এ ক্ষেত্রে তেমনি নিরাপত্তাব্যবস্থাও আগের তুলনায় জোরদার হয়েছে।

পৃথিবীর অন্যসব বনের রাজা হলো সিংহ। তবে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের রাজা বাঘ। গবেষকরা বলছেন, রহস্যময় প্রাণী এই রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এ প্রাণীকে নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক গবেষক কাজ করেছেন। তবে তারা আজও এর জীবনচক্র, স্বভাব এবং আচরণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেননি। অন্যদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রকৃতির এক অনন্যপ্রাণ। দিনে দিনে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে। এ প্রাণীকে রক্ষায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এ প্রাণীর আরেক বিচিত্র স্বভাব মানুষ শিকার।

পরিবেশবাদীরা বিভিন্ন সময় বলছেন, সুন্দরবনের বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবীর অন্যতম বিপন্ন প্রাণী। একে রক্ষা করা প্রয়োজন। সেজন্য বাঘের বিচরণ ক্ষেত্রের দখল নেওয়া থেকে মানুষকে বিরত থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে সুন্দরবনের নিরাপত্তাবেষ্টনী জোরদার করতে হবে।

তাদের মতে, সুন্দরবনের ওপর মানুষের নির্ভরতা অনেক কমেছে, যা একটি ইতিবাচক দিক।

Leave a Reply