শ্যামনগরে ইছামতি ও যমুনা নদী বিলুপ্তির পথে

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ১২, ২০২৪, ১২:১১

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দক্ষিণে সাগর। সাগর পাড়ে সুন্দরবন। অসংখ্য নদী সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান। যা সাগর থেকে উৎপত্তি এবং সুন্দরবন সংলগ্ন। এ নদীসমূহ উত্তর মুখে সাগরের জোয়ারের বর্ধিত পানি নিয়ে ধাবিত হয়েছে। আবার সাগরের ভাটার টানে উপরের সকল পানি নিয়ে সাগরের বুকে ফিরে এসেছে। এটাই এলাকার নদী সমূহের বৈশিষ্ট্য।উত্তরে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের বরফগলা পানি নীচের দিকে নেমে দক্ষিণ দিকে ধাবিত হয়েছে। নানান বাক নিয়ে বাধা পেরিয়ে দক্ষিণের সাগরের স্রোতধারার সাথে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণ-উত্তর এ দু’ধারার মিলনের গতিপ্রগতিতে সৃষ্ট হয়েছে অসংখ্য নদী, খাল, ভ‚মি, জনপদ আর সভ্যতা। বাংলাদেশ এ দু’ধারার মধ্যবর্তী। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম উপক‚লীয় অঞ্চল গড়ে উঠেছে সাগর-পর্বতে অপূর্ব জলকেলির মধ্য দিয়ে।হিমালয় পর্বত থেকে নেমে আসা প্রধান জলধারাটি গঙ্গা। গঙ্গার প্রধান শাখা ভাগিরথি নদী। ভাগিরথির প্রধান ধারা নানান বাঁক ও স্থান ঘুরে শ্যামনগরের (সাতক্ষীরা) মধ্যদিয়ে সাগরের সাথে মিলেছে। আর এই যাত্রা পথে কখনও যমুনা, কখনও ইছামতি, কখনও আদি যমুনা হয়ে ছুটেছে সাগরের দিকে। ভাগিরথির এ চলার পথে গড়ে উঠেছে নানান সভ্যতা, জনপদ ও ঐতিহ্য। গঙ্গা-ভাগিরথির প্রধান ধারা সাতক্ষীরার আদি যমুনা নদী। ফলে শ্যামনগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদী হচ্ছে গঙ্গা-ভাগিরথির সাগর সংগমের শেষ প্রান্ত।অনেকের মধ্যে সংশয় আছে যমুনা নদী নিয়ে। মূলত; সিরাজগঞ্জের পার্শ্বদিয়ে প্রবাহিত বিশাল ও প্রবাহময় যমুনা উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। যমুনা ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। হিমালয় থেকে উৎপন্ন গঙ্গার সাথে উত্তরবঙ্গের বঙ্গবন্ধু সেতুর যমুনার কোন সম্পর্ক নেই। ইতিহাস বলে সিরাজগঞ্জ সংলগ্ন যমুনার উৎপত্তি সাতক্ষীরার যমুনার অনেক পরে। সে কারণে বর্তমানে সাতক্ষীরার যমুনাকে আদি যমুনা বলা হয়। আজ অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অস্তিত্ব সংকটে আদি যমুনা। অবশ্য এলাকাবাসীর আন্দোলনের ফলে কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পেয়েছে আদি যমুনা।
শ্যামনগর-কালিগঞ্জের (সাতক্ষীরা) আদি যমুনা নদী পরিচয় তুলে ধরতে এ অঞ্চলের প্রথম ঐতিহাসিক সতীষ চন্দ্র মিত্র তাঁর যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন:“এ যমুনা সেই যমুনা।যে যমুনা তটে ইন্দ্রপুরিতুল্য রাজপাট বসাইয়া কুরুপাবে ইন্দ্রপ্রস্তহস্তিনাপুরে রাজুসুয়া যজ্ঞ সুসম্পন্ন করিয়াছিলেন,যে কালিন্দীতটে বংশীবটে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমধর্ম্মের অপূর্ব্ব লীলাভিনয়হইয়াছিল,যে যমুনা তীরে দিল্লী-আগ্রায় মথুরা-প্রয়াগে হিন্দু-মুসলমান,বৌধ্য-খৃষ্টান, মোঘল-ইংরেজশত শত রাজরাজেস্বর সমগ্র ভারতেররাজদণ্ড পরিচালনা করিতেন,এ সেই একই যমুনা।সেই তমালকদম্ব পরিশোভিত, ককিল-কুজন-মুখরিত,নির্মল সলিলে প্রবাহিততটশালিনী সুন্দর যমুনা।”
গঙ্গা, ভাগিরথি নামে সপ্তগ্রাম (পশ্চিমবাংলা) পর্যন্ত আসে। এখান হতে যমুনা নামে প্রথমে চব্বিশপরগানা ও নদীয়া এবং পরে চব্বিশ পরগানা ও যশোরের সীমানার মধ্যবর্তী দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। যমুনা ক্রমে চৌবাড়িয়া, জলেশ্বর, ইছাপুর ও গোবরডাঙ্গা ঘুরে চারঘাটের কাছে টিপির মোহনায় এসে ইছামতি নাম ধারণ করে। ইছামতি সোজা দক্ষিণ দিক দিয়ে যাত্রা শুরু করে বশিরহাট, টাকি হয়ে বাংলাদেশের দেবহাটার ধার দিয়ে কালিগঞ্জের বসন্তপুর-দমদমের মধ্য দিয়ে নাজিমগঞ্জের পূর্বধার হয়ে শ্যামনগরে ভুরুলিয়া দিয়ে শ্যামনগরে প্রবেশ করে। এখান থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে বংশীপুর (যেখানে বারুণের-ন হয়) যেয়ে দু’ভাগ হয়ে যমুনা নামে ডানমুখো হয়ে রমজাননগরের সোনাখালী ও শ্যামনগরের চিংড়ীখালির মধ্য দিয়ে মাদার নদীর সাথে মেলে। বংশীপুরে যমুনার অপর এক অংশ ইছামতি নাম নিয়ে বাম দিয়ে কদমতলী হয়ে মালঞ্চ হয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে। সুন্দরবনে প্রবেশ করা দু’ধারাই মালঞ্চ নামে আড়পাংশিয়া নদী হয়ে সাগর সংগমের প্রাক্কালে আবার যমুনা নাম ধারণ করে।
ইছামতির বসন্তপুর-দমদম এলাকা হতে শুরু করে মাদার নদীর সংযুক্তি পর্যন্ত আদি যমুনা প্রায় ৩২ কিলোমিটার। এ নদীর সাথে ৪০টির বেশী বিল ও একই পরিমান খালের সংযোগ রয়েছে। মূলত উপকূলীয় বাঁধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ পথ দিয়ে ইছামতির মিষ্টি পানির প্রবাহ সাগরে এবং সাগরের প্রবাহ ইছামতিতে আসা যাওয়া করতো। এ আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে নদী ও সংযুক্ত খালসমূহের নাব্যতা স্বভাবিক, পরিবেশ সহিষ্ণু ও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত ছিল।
আদি যমুনা নদী হলো সবচেয়ে ঐতিহ্য ও ইতিহাসখ্যাত নদী। এক সময় ইছামতি-আদি যমুনা-মাদার নদী হয়ে জাহাজ ভরে সওদা আসতো। বারো ভূইয়ার অন্যতম স্বাধীন নৃপতি প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল এ যমুনা কূলে। ‘যমুচ্ছোপ্রসঙ্গমে প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যশোহর ও ধুমঘাটের রাজধানী ছিল।’ এখনও টিকে আছে নৌপ্রতাশ্রয় জাহাজ ঘাটা। সনাতনী ধর্ম বিশ্বাসীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব বারুণের ¯œান এ যমুনাতে হয়ে আসছিল। এ যমুনা কূলে গড়ে উঠেছিল যশোরেশ্বী কালি মন্দির, ঐতিহাসিক মসজিদ ও উপমহাদেশের প্রথম র্গীজা। আদি যমুনা নদী সংলগ্ন জমিদার বাড়ি। শ্যামনগরের প্রধান মহাশ্মশান। এই যমুনা কূলে ছিল দোলযাত্রা উৎসব। যমুনা নদী থেকে মোঘল বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তৈরি করা ‘মাটির গড়’।
ইছামতির কালিগঞ্জের দমদম (ভাড়াশিমলা) ও বসন্তপুর (মথুরেশপুর) মধ্য এলাকা হতে শুরু হওয়া আদি যমুনা নদী দু’কিলোমিটর পর নাজিমগঞ্জের পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিণ মুখো বাঁক নিয়ে শ্যামনগরের মধ্যদিয়ে সাগর মুখে ধাবিত হয়েছে। নাজিমগঞ্জের পার্শ্বের এ বাঁক হতে সোজা পূর্ব দিক মুখ করে বৃটিশ নীল কুঠিয়ালরা ব্যবসার সুবিধার জন্য আঠারো শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে একটি সংযোগ খাল খনন করে। যেটি পরবর্তীতে কাকশিয়ালী নদী নামে পরিচিতি পায়। যোগাযোগের জন্য এ নদীটি কাটলেও পরবর্তীতে এ নদী উপক‚লীয় অঞ্চলের নদীর প্রবাহ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। তৈরী করে উপক‚লীয় এলাকার আন্তঃনদী সংযোগ।
ইছামতি নদীর আদি যমুনা ছাড়াও আরো একটি ক্ষীণ শাখা ছিল। যেটা কালিন্দি নামে রায়মঙ্গলের সাথে যুক্ত হয়েছে। বসন্তপুরের উত্তর-পশ্চিম ধার দিয়ে চলে যাওয়া কালিন্দি প্রতাপাদিত্যের সময়ে সাধারণ খাল ছিল। বৃটিশ সরকার ১৮১৬ সালে কোলকাতার সাথে যোগাযোগ সহজ করতে কালিন্দি হতে একটি খাল কেটে বড় কলাগাছির নদীর প্রবাহের সাথে যুক্ত করে। এটি সাহেবখালির খাল নামে পরিচিত। এ খাল কাটার ফলে ইছামতির পানি ভাটায় এ পথে যাওয়া শুরু করলে কালিন্দি বড় হতে শুরু করে। এর আগেই গুড্ডল্যাড সাহেব যখন চব্বিশ পরগানার কালেক্টর তখন যমুনা থেকে একটি খাল কেটে বাশতলা দিয়ে খোলপেটুয়া নদীর সাথে যুক্ত করে। যা কাকশিয়ালীর খাল (এড়ড়ফষধফ পৎববশ) বলে পরিচিত। এরপর আরো নদীপথ সংক্ষিপ্ত করতে হাসনাবাদ খাল খনন করা হয়। বৃটিশ সরকার কর্তৃক বাণিজ্যিক কারণে এ তিনটি সংযোগ খাল কাটায় আদি ইছামতি-যমুনা নদীর প্রবাহ অনেকাংশে কমে যায়।
গুড্ডল্যাড সাহেব ইছামতি হতে আসা আদি যমুনা নদীর নাজিমগঞ্জ বাজারের উত্তরপূর্ব ধার হতে কাকশিয়ালী খালটি খনন করে চম্পাফুল ইউনিয়নের উজিরপুরের ত্রিমোহনীতে গুতিয়াখালী ও হাবড়া নদীর সাথে যুক্ত করে। আগেই এখান থেকে ধারা ছিল। ফলে এলাকাটি ত্রিমোহনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সংযোগে ইছামতির সাথে হাবড়া ও গুতিয়াখালী নদীর সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পথ তৈরী হয়। সংযুক্ত খালটি গুতিয়াখালি নদীর সাথে মিশে ঘুরে দক্ষিণ মুখো হয়ে (উপরে বর্ণিত) কালিগঞ্জের বাঁশতলা ও আশাশুনির শ্রীউলার মধ্যবর্তী নদী গলঘেসিয়ার সাথে মিশে খোলপেটুয়ার সাথে যুক্ত হয়।আদি যমুনা নদী হতে খনন করে কাকশিয়ালি খালকে চম্পাফুল ইউনিয়নের উজিরপুরের ত্রিমোহনীতে গুতিয়াখালী ও হাবড়া নদীর সাথে যুক্ত করা হয়। ফলে এখানে এসে কাকশিয়ালির মাধ্যমে ইছামতি-যমুনার সংযোগ সংযুক্ত হয়। কাকশিয়ালির একটি ধারা গুতিয়াখালি নদীর সাথে মিশে ঘুরে দক্ষিণ মুখ্ োহয়ে কালিগঞ্জের বাঁশতলা ও আশাশুনির শ্রীউলার মধ্যবর্তী নদী গলঘেসিয়ার সাথে মিশে খোলপেটুয়ার সাথে যুক্ত হয়। খোলপেটুয়া সাগর থেকে উঠে আসা অন্যতম প্রধান জোয়ার ভাটার নদী। আর একটি ধারা উজিরপুরের নিকট হাবড়া নদীর সাথে মিলিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম মুখো হয়ে দেবহাটার কুলিয়াব্রিজের নীচ দিয়ে প্রবাহিত লাবণ্যবতী নদীর সাথে মিলিত হয়। লাবণ্যবতী নদী ইছামতির কোমরপুর (দেবহাটার) হতে উঠে আসা একটি প্রবাহমান সংযোগ নদী।
আগে থেকেই উজিরপুরের নিকট হতে হাবড়া নদী উত্তর-পশ্চিম মুখো হয়ে দেবহাটার কুলিয়া ব্রিজের নীচ দিয়ে প্রবাহিত লাবণ্যবতী নদীর সাথে মিলিত ছিল। লাবণ্যবতী নদী ইছামতির কোমরপুর (দেবহাটার) হতে উঠে আসা একটি প্রবাহমান সংযোগ নদী। (ইছামতি নদীর কোমরপুর ***(যেখানে ইসগেট) কুমরোর খাল কুলিয়া ব্রিজের কাছে লাবণ্যবতী, টিকেট হয়ে কোলকাতার খাল হয়ে কদমখালি হয়ে বাকালের খাল মরিচ্চাপ নদীর সাথে যুক্ত। মরিচ্চাপের এল্লারচর এলাকা হতে খাজুর ডাঙ্গি পর্যন্ত কেটে বেতনার সাতে যুক্ত) লাবণ্যবতী নদী সাতক্ষীরা শহরের পশ্চিমাংশের খালসমূহের সাথে সংযুক্ত। কাকশিয়ালী ত্রিমহোনীতে যুক্ত হওয়ায় হাবড়ার এ শাখার প্রবাহ আরো গতিশীল হয়। ইছামতি নদীর পানি কোমরপুর দিয়ে ঘুরে আবার মরিচ্চাপে পড়ার পথ তৈরী হয়। দু’ধারার হাবড়া নদীর অপর ধারা উত্তর-পূর্ব মুখী হয়ে বদরতলা, শোভনালী, ব্যাংদহ হয়ে মরিচ্চাপের সাথে যুক্ত ছিল। মরিচ্চাপ সাগরযুক্ত খোলপেটুয়ার সাথে মিলিত প্রবাহমান নদী। অন্যদিকে মরিচ্চাপ নদীর সাথে সাতক্ষীরার বেতনা নদীর সংযোগ আগে থেকে ছিল।
কাকশিয়ালী নদীর ধারা ত্রিমোহনীতে যুক্ত হওয়ায় মরিচ্চাপের প্রবাহ ইছামতির (কালিগঞ্জ) প্রবাহের সংযোগে সকল নদীর সংযোগ তৈরি করে। নদীসমূহকে প্রবাহময় করে। নদীপথে যোগাযোগের একটি আন্তঃঅঞ্চলীয় ব্যবস্থাপনা তৈরী হয়। পরবর্তীতে প্রাণসায়ের খনন করা হলে এ সংযোগ আরো গতিময় হয়। তখন বেতনা প্রবাহ খেজুর ডাঙ্গি হয়ে সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে এল্লাচ্চর হয়ে মরিচ্চাপে পড়া সহজ হয়।ইছামতি, বেতনা, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, লাবণ্যবতী, যমুনা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে সাতক্ষীরা, আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর এ অঞ্চলের নদীর প্রবাহের মধ্যে একটি আন্তঃসংযোগ তৈরি করে। ফলে সাগরের সংযোগের সাথে ইছামতি, বেতনা ও মরিচ্চাপের সংযোগ তৈরি হয়। অন্যদিকে ইছামতি প্রবাহ সরাসরি সাতক্ষীরার বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে মরিচ্চাপে পড়ে। ফলে এলাকাতে একটি সৃজনশীল পরিবেশ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠে। এক নদীতে জোয়ার হতো তখন অন্যটায় ভাটা হতো। আর এভাবেই নদীসমূহে সকল সময় জোয়ার-ভাটার প্রবাহ থাকায় শুধু প্রধান নদী নয় অভ্যন্তরীণ সকল নদী খালের সচল ও গতিশীলতা তৈরী করে।
উপক‚লীয় বাঁধ নির্মাণ করার সময় এ নদীসমূহের প্রবাহ বিবেচনা না করে, নদীর পানির সাথে আসা পলি ব্যবস্থাপনার বিষয় এবং এলাকার পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিবেচনা না করে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও ইস গেট নির্মাণ করে এ অঞ্চলের নদীর প্রবাহ ধ্বংস করা হয়। উপকূলীয় অঞ্চলকে নিক্ষেপ করা হয় এক বৈরী পরিবেশের মধ্যে। ভেঙে যায় সৃজনশীল পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। নষ্ট হয় খাদ্য নিরাপত্তা বলয়।
আগেই বলা হয়েছে, ইছামতি-আদি যমুনা নদী শুধু শ্যামনগর-কালিগঞ্জ উপজেলার নদী নয়, আজ সাতক্ষীরা, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা ও পানি প্রবাহের একমাত্র সম্ভাবনাময় ধারা। আর এ বাস্তবতার নিরিখে ইছামতি-যমুনার প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে জেলার ঝুঁকিতে থাকা প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা অনেকাংশে সম্ভব। এই সঙ্গে ইছমতির কোমপুরের দেবহাটার নিকট নির্মিত ¯ইসগেটটিও পরিবর্তন করে প্রবাহ স্বাভাবিক চলাচলের ব্যবস্থা করলে সামগ্রিক সাতক্ষীরা নিরাপদ হতে পারে জলাবদ্ধতার হাত থেকে।ইছামতির জলধারাকে ব্যবহার করে কালিগঞ্জ-শ্যামনগরকে যেমন প্রবাহময় করা যায়, তেমনি ত্রিমোহনীর মাধ্যমে দেবহাটা, সাতক্ষীরা ও আশাশুনির নদীসমূহের প্রবাহ পূর্বের ন্যায় সচল করা গেলে আজকের সবচেয়ে বড় সংকট জলাবদ্ধতার অভিশাপ মুক্ত করা সম্ভব। পাশাপাশি নদীসমূহের নাব্যতাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
২নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সভ্যতা। উপক‚লীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনাও তৈরি হয় নদীর প্রবাহের মধ্য দিয়ে। কিন্তু উন্নয়ন পরিকল্পনায় কখনও নদীর অবস্থান বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সড়ক পথের উন্নয়নের নামে ব্যাপকভাবে নদীকে আটকে দেওয়া হয়। উপক‚লীয় অঞ্চলের নদীকে ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় আয়োজন হলো ষাটের দশকের উপক‚লীয় বাঁধ নির্মাণ।আবহমান কালধরে জোয়ার ভাটার প্রবাহের সাথে আসা পলি উপক‚লীয় অঞ্চলে ভ‚মি গঠন করে। পলি ভ‚মি গঠন যেমন করেছে তেমনি জমির উর্বরতাকে ধরে রাখতেও ভ‚মিকা রেখেছে। সাগরের লোনা পানি আর উপরের মিষ্টি পানির সংমিশ্রণে এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা তৈরি। যার শুরু এলাকার ভ‚মিগঠন হতে। জোয়ার ভাটার প্রবাহ নদীসমূহের নাব্যতা বজায় রাখে। প্রবাহের কারণে নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা স্বাভাবিক থাকায় প্রাকৃতিক কারণে নদী গতিপথ পরিবর্তন না করলে সে নদী মরে যাওয়া ঘটনা ছিল বিরল।দেশ বা রাষ্ট্রের উন্নয়নে সড়ক, রেল ও আকাশপথ নিয়ে যত তোড়জোড় করা হয়েছে নদীপথ নিয়ে তার সিকিও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নদী সকল সময় থেকেছে আলোচনার বাইরে। অথচ স্বল্প ব্যয়ে ও পরিবেশ সহযোগী হিসেবে যোগযোগের মাধ্যম হিসেবে নদী পথের বিকল্প নেই। দেশের নদীর পানিকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে যে উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল সেটি কখনও নেওয়া হয়নি। বিবেচনায় নিয়ে আসা হয়নি যে প্রবাহময় নদীর পানিও সম্পদ। মাছে ভাতে বাঙালির মাছের অস্তিত্ব যে নদী কেন্দ্রিক সেটি ভুলে আছেন তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকা বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ।পৃথিবীর সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এ বনের জীববৈচিত্র্যের স্থায়ীত্ব নির্ভরশীল নদীর প্রবাহের উপর। লোনা ও মিষ্টি পানির সংমিশ্রণ সুন্দরনের সম্পদের বিকাশের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবনের সকল এলাকায় একই ধরনের বৃক্ষ হয় না। পানির মান তথা লোনার তীব্রতার কম বেশীর কারণে অঞ্চল ভেদে বৃক্ষের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে থাকে। কিন্ত দেশের উন্নয়নের ধারক ও পরিবেশ সংরক্ষণের সিলমারা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে নদী মারা ও নদীর প্রবাহ বিচ্ছিন্ন করার কোন উদ্যোগ প্রতিরোধে ভ‚মিকা না নিয়ে আজ জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার নানান আয়োজনে ব্যস্ত। মিষ্টি পানির প্রবাহ সাগরের লোনা পানির সাথে মিশ্রণে প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রেখে যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা আবহমান কাল ধরে চলে আসছিল, তা বন্ধ করার মাধ্যমে সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুরু করা হয়েছে ব্যাপকভাবে সুন্দবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সোচ্চার হয়ে উঠার আহŸান।মানুষ বসতি গড়ে ওঠে নদীর প্রবাহকে বিবেচনায় করে। নদীক‚লে মানুষ নির্মান করে আবাস, বাজার ইত্যাদি। পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে প্রবাহময় নদীর সন্নিকটে। তেমনিভাবে উপক‚লে যখন মনুষ্য বসতি নির্মিত হয়েছে তখনও নদীর প্রবাহ ও নদীপথকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাগর, বন আর ভ‚মি সমানভাবে বিচরণ ক্ষেত্র ছিল উপক‚লীয় মানুষের। এককভাবে কোনটির উপর নির্ভর থাকেনি। একটা সময় বন তার জীবিকার ক্ষেত্র, একসময় নদীসাগর আর এক সময় ভ‚মি বা কৃষি। তবে কৃষিতে বেশী সময় থাকতো মানুষ। নদীর প্রবাহ কেন্দ্র করে শিল্প-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-সভ্যতা, পেশা তৈরি করে নিয়ে আবহমানকাল ধরে উপক‚লে বসবাস করে আসছে মানুষ। কিন্তু মানুষের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, পেশা কোনটাই বিবেচনা করা হয়নি উপক‚লীয় বাঁধ নির্মাণের সময়।যোগাযোগের উন্নয়ন, অধিক ফসল ফলানো, বসতি নিরাপদ করা, নানান মিষ্টি কথার মালা সাজিয়ে জোয়ার ভাটার প্রবাহ বিচ্ছিন্ন করে নদী মারার আয়োজন শুরু করা হয়। নদী মারার আয়োজনে পথ প্রশস্ত হয় বহুজাতিক কোম্পানির বাজার সম্প্রসারণের। টেকসই দেশীয় ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া থামিয়ে রাসায়নিক সার-কীটনাশক যুক্ত হইব্রিড বীজ আমদানি করা হয়। দেশীয়ভাবে উৎসাহিত করা হয় নদী দখলের। ভ‚মি দস্যুদের দখলে চলে যায় নদীরক‚লসহ প্রবাহ বিচ্ছিন্ন অধিকাংশ নদী। সম্পদশালীদের সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্র হয়ে যায় অবৈধভাবে নদী দখল। আর সব সময় এ দখলের সহযোগী হয়েছে প্রশাসন বা রাষ্ট্রযন্ত্র। রাজস্ব আয়ের নামে নদী, জলাশয় সব সময় বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। কৃষি জমির পরিমান স্ফীত করার ক্ষেত্র হলো মরে যাওয়া নদী খাল আর মজে যাওয়া নদীর চর।উপক‚লীয় জেলা সাতক্ষীরার ভ‚মির গঠনে প্রধান ভ‚মিকা রাখে গঙ্গা-পদ্মা-গড়াই-ভৈরব-কপোতাক্ষ এবং গঙ্গা-ভাগিরথি-যমুনা-ইছামতি-যমুনা-মাদার, এ দু’প্রবাহ। গঙ্গার প্রধান এ দু’শাখার পানি সাগরে গেছে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে। পশ্চিমে কালিন্দি আর পূর্বে কপোতাক্ষ এবং মধ্যে খোলপেটুয়া, মালঞ্চ, মাদার সাগর সংযুক্ত নদী। আর এ নদীগুলোর শেষ ভাগে সাগরক‚লে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। সুন্দরবন যখন সমগ্র এলাকা ঢেকে রাখে তখনও এ ধারার অস্তিত্ব ছিল। তবে মাঝে মধ্যে নদীর প্রবাহ কোনটার বেশী কোনটার কম হয়েছে। যে কালিন্দি একসময় খাল ছিল এখন সেটি বড় নদী। আবার আদি যমুনা ছিল সবচেয়ে বৃহৎ, সেটি আজ অস্তিত্বের লড়াই করছে। চুনার নদী উৎস বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কপোতাক্ষ ভৈরবের সাথে সংযোগ হারিয়ে মরতে বসেছে। মরিচ্চাপ প্রবাহহীন প্রায়। এসকল ঘটনার পিছনে মনুষ্য সৃষ্ট নানান ঘটনা যেমন ছিল, তেমনি প্রাকৃতিক ঘটনাও ভ‚মিকা রাখে। তবে সকল ক্ষেত্রে ছিল নদীকে পরিকল্পনাহীনভাবে ব্যবহার করা। নদীর পানির প্রবাহমানতাকে বিবেচনা না করা। নদীর পলির বিষয় মাথায় না রাখার বাস্তব বিবর্জিত কর্মকা বাস্তবায়ন।
৩উপক‚লীয় নদীর প্রবাহের সাথে পানি ও পলি ব্যবস্থাপনা বিবেচনা না করার ফলে আজ জলাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি। এ অঞ্চলের উপর দিয়ে গঙ্গার প্রধান দু’শাখার জলধারা সাগরে যুক্ত হয়েছে। আবার সাগর যুক্ত থাকায় জোয়ার ভাটার প্রভাবে নদীসমূহ ছিল প্রবাহমান। গঙ্গার পানি সাগরে যাওয়া ও সাগরের জোয়ার ভাটার প্রবাহের অসংখ্য নদী খাল তৈরি হয় এলাকাতে ।সংকটের পটভ‚মি তৈরি হয় নদীর উপর অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, জোয়ার-ভাটার প্রবাহ বন্ধ করা, নদী-খাল মাছ চাষের নামে লিজ দেওয়া ও অবৈধ দখল হওয়ার ফলে। পানি নিষ্কাশনের নদীসমূহ লিজ দেওয়া, রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে উন্নয়নের নামে অপ-উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা, পানি উন্নয়ন বোর্ড এর মাধ্যমে উপক‚লীয় বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধ্বংস করার মধ্যদিয়ে। নদীর করুণ মৃত্যু শুরু এ প্রতিষ্ঠানটির হাত দিয়ে। এরপর সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে নদীর বুকে নির্মাণ করে স্থাপনা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ এলাকার জীববৈচিত্র্য, স্থায়ীত্বশীল জীবন জীবিকার বিষয় অজ্ঞতা হেতু স্থাপনা নির্মাণে একের পর এক অনুমতিপত্র প্রদান করেন। নদী ধ্বংসের আরো একটি কারণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একমুখী ¯ইস্যু গেট। সড়ক ও জনপথ বিভাগ রাস্তা তৈরির সময় নদীর প্রশস্ততা বিবেচনা না করে নদী অপেক্ষা অনেক ছোট করে কালর্ভাট ও পুল নির্মাণ করে।এলাকার প্রধান দু’নদী কপোতাক্ষ ও ইছামতি এ অঞ্চলের ভ‚মি গঠনে ভ‚মিকা রাখে। সাগর সংলগ্ন হওয়ায় জোয়ার ভাটার প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে এ দ্বীপাঞ্চল গঠনে। সাগরযুক্ত নদীগুলো হলো- খোলপেটুয়া, রায়মঙ্গল, মালঞ্চ, চুনা, আড়পাংশিয়া প্রভৃতি। কপোতাক্ষ ইছামতির যুক্ত নদীসমূহ বেতনা, শালিখা, লাবণ্যবতী, আদি যমুনা, মরিচ্চাপ ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি খাল কেটে নদী প্রবাহের সাথে যুক্ত করা হয়, যেগুলো পরবর্তীতে আন্তঃনদী সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। যেমন- প্রাণ সায়ের (বেতনার সাথে মরিচ্চাপ নদীর সংযোগ), কোলকাতার খাল (লাবণ্যবতীর সাথে এল্লারচর হয়ে মরিচ্চাপ নদীর সাথে যুক্ত), কাকশিয়ালী (কালিগঞ্জের নাজিমগঞ্জ এলাকার আদি যমুনা নদী হতে শুরু হয়ে উজিরপুরের ত্রিমোহনীর সাথে যুক্ত)। এর বাইরে আরো অসংখ্য নদী খাল রয়েছে। সকল খাল নদী পরস্পর যুক্ত এবং একে অন্যের পানি কখনও নিজে ধারণ করেছে, কখনও বহন করে নিয়ে প্রবাহের ধারা সচল রেখেছে। মিষ্টি ও লোনা পানির সংমিশ্রণে এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে।বর্তমানে প্রবাহমান একমাত্র নদী ইছামতি। উৎপত্তিস্থল ভারতে হওয়ায় বছরের ৭-৮ মাস উজানের পানি প্রবাহ থাকে এই নদীতে। ১৯৭২-৭৩ সালে স্থানীয় জনগণের প্রবল বাধা উপেক্ষা করে ইছামতি-লাবণ্যবতী নদীর সংযোগস্থল দেবহাটার শাখরায় ১৫ ভেন্টের একটি ইস গেট নির্মাণ করা হয়। একই সময়ে ইছামতির ভাতশালা নামক স্থানে সাপমারা নদীর সংযোগ স্থলে আরো একটি ইস গেট নির্মাণ করা হয়। লাবণ্যবতী ও সাপমারা নদীর অপর প্রান্তে মরিচ্চাপের সংযোগস্থলে টিকেট, কামালকাটি, শালখালী, বালিথাসহ বিভিন্ন স্থানে আরো অসংখ্য ইস গেট নির্মাণ করা হয়। আর এ কারণেই অল্প দিনের মধ্যেই লাবণ্যবতী, সাপমারা, মরিচ্চাপ নদী এবং তার অসংখ্য শাখা খাল অস্তিত্ব হারায়। যার প্রভাবে বেতনা ও খোলপেটুয়া নদীও নাব্যতা হারায়। ইছামতির কালিগঞ্জ উপজেলার বসন্তপুরের উত্তর ধারা আদি যমুনা নাম নিয়ে নাজিমগঞ্জ বাজারের পূর্ব পার্শ দিয়ে শ্যামনগরের মধ্যদিয়ে মাদার নদীর সাথে মিশে সাগরে যুক্ত হওয়ায় প্রবাহময় ছিল। উপক‚লীয় বাধ নির্মাণের সময় কালিগঞ্জের নাজিমগঞ্জ বাজারের পাশে আড়াআড়ি আদি যমুনার উপর বাধ নির্মাণ করে এবং সেখানে ৪ ফ্কোরের একটি ¯ইস্যু গেট নির্মাণ করে নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। আদি যমুনা ও মাদার নদীর সংযোগস্থলে আড়াআড়ি বাধ দিয়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে আদি যমুনা নদীর প্রবাহ নষ্ট হয়ে যায় এবং নদী নাব্যতা হারায়। অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ সড়ক নির্মাণের সময় শ্যামনগর শ্মশানের সামনে আদি যমুনার উপর কোনধরনের পানি চলাচলের পথ না রেখে রাস্তা তৈরি করে। যা নদীকে দু’খণ্ড ভাগ করে দেয়।ইছামতির বাংলাদেশে প্রবেশস্থলই একমাত্র যায়গা যেখানে উপক‚লীয় বাধ হয় নি। ফলে এ পথে ইছামতির প্রবাহ সচল আছে। ইছামতির সম্মুখ ভাগ কালিন্দি নামে বাংলাদেশ ভারতের সীমানা নির্ধারণ করে রায়মঙ্গলে যুক্ত হয়ে সাগরে মিশেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ মুন্সিগঞ্জ-যশোর সড়ক নির্মাণকালে সাতক্ষীরার বেতনা, লাবণ্যবতী, কোলকাতার খাল, প্রাণসায়ের ও আদি যমুনাসহ অসংখ্যা নদী খালের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে ও কোথাও পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় গত দুই দশক ধরে মানুষ ইছামতি নদীর সাথে সাতক্ষীরার অন্যান্য নদীগুলোর পূর্বের ন্যায় জোয়ার-ভাটার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে। কারণ ইছামতির জোয়ারের পানি ভাটি হয়ে নামতো লাবণ্যবতী, সাপমারা, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, আদি যমুনা ও মাদার নদী দিয়ে। আবার এসব নদীর জোয়ারের পানি ইছামতি নদীতে ভাটি হয়ে নামতো। আর এর সাথে দূরবর্তী হলেও সংযোগ ছিল বেতনা এবং কপোতাক্ষের। যত প্রকল্পই নেয়া হোক না কেন জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি ছাড়া বর্তমান সমস্যা সমাধান নয়।বেতনা নদীর একটি শাখা সাতক্ষীরার খেজুর ডাঙ্গি এলাকা হয়ে কদমতলা ঝাউডাঙ্গা হয়ে সোনাই নদীতে যুক্ত হয়। এ নদী থেকে একটি খাল কেটে সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে এল্লাচর হয়ে মরিচ্চাপের সাথে যোগ করে দেওয়া হয়। যেটি প্রাণ সায়ের নামে পরিচিত। বেতনার পানি প্রাণসায়ের দিয়ে মরিচ্চাপে ও একইভাবে সোনাই নদীর পানিও প্রাণসায়ের হয়ে চলাচল করায় সাতক্ষীরা সদরের লাবসাসহ সমগ্র এলাকা ছিল অবাধ প্রবাহ যুক্ত এলাকা। এলাকাতে আগে কখনও পানি জমা হয়নি বা জলাবদ্ধতা দেখা দেয়নি। কিন্তু বেতনা ও প্রাণসায়ের এই সংযোগ খালের খেজুরডাঙ্গিতে ৬ ভেন্টের ইস গেট নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই নদী মরে স্থায়ী জলবদ্ধতার দিকে এগুতে থাকে।সামগ্রিক ভাবে সাতক্ষীরাকে বিরূপ পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, নদীর ধ্বংস আর জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করতে ইছামতি নদীর প্রবাহ সাগরে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করে জোয়ার ভাটার প্রবাহের বাধা অপসারণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। নদীর স্বাভাবিক গতি পথই জলমগ্ন অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। আর এটা নীতি নির্ধারক মহল যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তত দ্রুত মানুষ নিষ্কৃতি পাবে এই সংকট থেকে। গড়ে উঠবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সক্ষম পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। এ জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক মাস্টার প্লান। গবেষণা ও অব্যাহত প্রচার ধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নীতি নির্ধারকদের উপর চাপ রাখতে হবে।
বর্তমানে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে:১. নাজিমগঞ্জের পাশের ইস গেট অপসারণ করে জোয়ার ভাটার প্রবাহ বাধা মুক্ত করা।২. ইছামতি-আদি যমুনা-কাকশিয়ালী গুতিয়াখালি-গলঘেসিয়া-খোলপেটুয়া নদীর প্রবাহকে সচল করা।৩. ইছামতি-আদি যমুনা-কাকশিয়ালী-হাবড়া-লাবণ্যবতী(কুলিয়া ব্রিজের নীচ দিয়ে)-ইছামতি নদীর প্রবাহ বাধা মুক্ত করা।৪. ইছামতি-আদি যমুনা-কাকশিয়ালী-হাবড়া-(বদরতলা, শোবনালী, ব্যংদহ হয়ে)-মরিচ্চাপ নদীর প্রবাহ বাধা মুক্ত করা।৫. বেতনা-প্রাণসায়ের-মরিচ্চাপ নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক করা।৬. বেতনা-খোলপেটুয়া নদীর প্রবাহ বাধা মুক্ত করা।৭. কোমপুরের ইস গেট অপসারণপূর্বক সরাসরি পানির প্রবাহ চলাচলের উদ্যোগ গ্রহণ করা।৮. ইছামতি-আদি যমুনা-মাদার নদী সংযোগ সচল করে সাগরে যুক্ত করা।৯. হাবড়া-বদরতলা-শোভনালী-ব্যাংদহ হয়ে মরিচ্চাপের সংযোগ গতিময় করার ব্যবস্থা করা।

Leave a Reply