শ্যামনগর চাকুরী না করে মনোতোষ সবজি চাষে স্বাবলম্বী

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ৫, ২০২৪, ১২:৪৬

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : শ্যামনগর সাতক্ষীরা ভুরুলিয়া ইউনিয়নের মনোতস মন্ডল বিয়ে অনার্স করে চাকরির আসায় ঘুরে ঘুরে চাকরি না পেয়ে অবশেষে প্রতিক্র
৮৫ শতক জমির উপর নির্ভর করে অতিকষ্টে সংসার চালাতেন শ্যামনগর উপজেলার হাটচালা গ্রামের মনোতোষ মন্ডল। বাড়তি রোজগারের আশায় গ্রামে গ্রামে হেঁটে শাঁখা বিক্রির আয়ে কোন রকমে চার সদস্যের পরিবারের খরচ যোগাতেন তিনি। তবে স্বচ্ছলতার নাগাল না পেয়ে চিন্তায় পরিবর্তন আনতে হয় তাকে। সাংসারিক চাহিদা পুরণের জন্য বাড়ির আঙিনায় চাষাবাদকৃত সবজি ক্ষেতের পরিধি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন তিনি।
মনোতোষ মন্ডল জানান, শুরুতে তিনি প্রায় ১৫ শতক এক ফসলী চাষের জমিতে পুকুর খনন করেন। আর সেই মাটি দিয়ে পাশর্^বর্তী নিচু জমির কিছু অংশ ভরাট করে সবজি চাষের জন্য ‘ভিটা’ প্রস্তুত করেন। এসময় সেচের চিন্তা দুর হওয়ার পাশাপাশি আগের এক ফসলী জমি উঁচু ‘ভিটা’য় পরিণত হলে সারা বছর সেখানে পর্যায়ক্রমে উচ্ছে, বেগুন, ঢেঁড়স আর কপি পালনশাকের চাষ শুরু করেন। এভাবে বছর তিনেক ঘুরতেই ভাগ্যের পরিবর্তন হলে গ্রামে হেঁটে শাখা বিক্রির কাজ ছাড়েন। মাত্র ২৫ শতক জমিতে মোট খরচের পাঁচ থেকে সাত গুন ‘লাভ’ ঘরে আসায় তিন বছরের ব্যবধানে আরও ৪৩ শতক জমিতে সবজী চাষের সিদ্ধান্ত নেন। একইভাবে তিনি দ্বিতীয় খন্ডের জমিতে নুতন পুকুর খননসহ পাশের নিচু জমির কিছুটা ভরাট করে আরও একটি ‘ভিটা’ গড়েন সবজী চাষের উপযোগী করে।

এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দুই সন্তানের জনক মনোতোষ মন্ডলকে। চাকরিজীবী ভাই ও প্রতিবেশীদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে এক সময় তার মধ্যে আক্ষেপ কাজ করলেও এখন তিনি সম্পূর্ণ নির্ভর। জায়গা-জমি ক্রয়ের পাশাপাশি বসবাস উপযোগী দালানকোঠা তৈরীসহ এলাকাবাসীর কাছে ‘মডেল’-এ পরিনত হয়েছেন তিনি। মনোতোষকে অনুসরণ করে হাটচালা ছাড়াও পাশের দেওল ও শংকরকাঠি গ্রামের কয়েক শ’ পরিবার এখন ছোট-বড় সবজি চাষী হয়ে উঠেছেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে ৩০ বছর আগে শুরু করা সবজি চাষ এখন তাকে রীতিমত এতদাঞ্চলে সবজি চাষের পুরোধা’য় পরিণত করেছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে শ্যামনগরের ওই তিনটি গ্রাম সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পুরণের পাশাপাশি তাদের উৎপাদিত উচ্ছে, বেগুন, পালনশাক, বাঁধা কপি, ওল কপি, কাঁচা মরিচ, কুমড়া, পালনশাক ও ঢেঁড়স রাজধানী ঢাকাসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছে। কৃষকরা জানায়, লবণাক্ততার প্রভাব ও মিষ্টি পানির অভাবে তাদের এলাকা কৃষি ফসল উৎপাদনের অনুকুল নয়। কিন্তু মনোতোষের দেখিয়ে দেয়া পথে হেঁটে বিরূপ পরিবেশেও এক সময়ের এক ফসলী জমিতে এখন তারা রীতিমত সোনা ফলিয়ে চলেছেন। এছাড়া পদ্মা সেতুর কল্যাণে উৎপাদিত সবজি দেশের বৃহত্তম বাজারগুলোতে পৌঁছানোর সুযোগ মেলায় শেষ দু’বছরে তারা আর্থিকভাবে আশাতীতভাবে লাভবান হচ্ছেন।
দেওল গ্রামের মৃত বাবুরাম মন্ডলের ছেলে অক্ষয় মন্ডল বলেন, পৈত্রিকসুত্রে তিনি মাত্র ২৫ শতকা জমি পেয়েছিলেন। মনোতোষের মতই শুরুতে জমির একপাশে ছোট একটি পুকুর খনন করে পানির বন্দোবস্ত ছাড়াও নিঁচু জমিকে ‘ভিটা’য় পরিনত করেন। একপর্যায়ে সারা বছর সেখানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পর্যায়ক্রমে করোলা, কপি, ঢেঁড়সসহ নানান সবজি চাষ শুরু করেন। অক্ষয়ের দাবি মাত্র আট-নয় বছরের ব্যবধানে তিনি আরও ১৬ শতক জমি ক্রয় করেন এবং সেখানে একইভাবে সবজি ফলিয়ে দারুণভাবে লাভবান হচ্ছেন। চলতি বছরে মাত্র আট শতকের প্লটে পাঁচ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে ৪২ হাজার টাকার পালনশাক বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন একইভাবে ১৬ শতকের প্লটে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে প্রায় একলাখ টাকার বাঁধা কপি বিক্রি করেছেন।

মনোতোষের দ্বারা অনুপ্রানিত হওয়ার তথ্য দিয়ে অক্ষয় মন্ডল জানান মাত্র ২৫ শতাংশ জমিতে ভরসা করে নিজের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি। পাকা বাড়ি-ঘর তৈরীসহ সার-কীটনাশকের দোকান দেয়ার পাশাপাশি দুই সন্তানকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন তিনি। এছাড়া দেড় লাখ টাকায় গোয়াল ঘর তৈরীসহ তিনটি গরু ক্রয়ের যাবতীয় অর্থ সবজি চাষ থেকে এসেছে বলেও তিনি জানান।
স্থানীয়দের দাবি সবজি চাষ শুধুমাত্র এলাকার কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটায়নি। বরং এলাকার ফড়িয়া ও শ্রমিক শ্রেনীসহ সব ধরণের ব্যবসায়ীর আয়-রোজগারের গ্রাফকে উর্ধ্বমুখী করেছে। শংকরকাটি গ্রামের সফিকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে সবজি চাষ এলাকার প্রতিটি পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছে। একসময় মানুষের বাড়ি আর ক্ষেত-খামারে শ্রমিকের কাজ করা মানুষ এখন নিজের এক টুকরা জমিতে সবজি চাষ করে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে তৎপর। সব শ্রেণিপেশার মানুষের আয় রোজগার বৃদ্ধিতে এলাকার সার্বিক পরিবেশ উন্নতি ঘটেছে।

তবে সফলতার বিপরীতে স্থানীয় চাষীরা তাদের কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। তারা জানান, এলাকার রাস্তা-ঘাট কাঁচা ও প্রশস্থ না হওয়ায় সবজি বহনের কাজে ব্যবহৃত পরিবহন সরাসরি গ্রামে ঢুকতে পারে না। ফলে ফড়িয়ারা সিন্ডিকেট গড়ে তাদের সবজীর দম কমিয়ে দেয়ার সুযোগ নেয়। এছাড়া বর্ষার সময়ে বাজারে নিয়ে যেতে দেরী হলে অনেকের সবজি অবিক্রিত থাকার পাশাপাশি কম মূল্যে ছেড়ে দিতে হয়। আবার আগ্রহ থাকা সত্তে¡ও সেচ সংকটের কারণে তারা তুলনামুলক বেশি জমিতে সবজি চাষের সুযোগ হারাচ্ছেন।

দেওল গ্রামের জগবন্ধু মন্ডল বলেন, তাদের তিন ভাইয়ের সবজি চাষের উপযোগী প্রায় তিন বিঘা জমি রয়েছে। কিন্তু পানি সংকটের কারণে মাত্র এক বিঘা জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। প্রতিবছর সে জমি থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি ফলিয়ে দেড় লাখেরও বেশি টাকা উপার্জন করছেন। তবে পানির অভাবে বাকি দুই বিঘা জমি সবজি চাষের আওতায় নিতে না পারায় বছরে ন্যুনতম দুই লাখ টাকার মুনাফা বঞ্চিত হচ্ছেন তার পরিবার। এছাড়া সময়মত কৃষি বিভাগের কর্মকর্তার দেখা না পাওয়ার পাশাপাশি কৃষি উপকরণ বন্টনে কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন কোমলেশ, আব্দুল কাদের ও অলকা রানীসহ কয়েকজন চাষী।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ জাফরুল আলম বাবু বলেন, হাটচালার মনোতোষের দেখিয়ে দেয়া পথে হেঁটে এখন তিন গ্রামের প্রতিটি মানুষ আর্থিকভাবে স্ববচ্ছল। এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতির ফলে সেখানকার জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের সিরাজপুর, তেঘরিয়াসহ আরও কয়েকটি গ্রামে মানুষ সবজি চাষে ঝুঁকছে বলেও তিনি দাবি করেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, ওই তিন গ্রামের প্রায় ২০০ থেকে ২২০ হেক্টর জমিতে স্থানীয়রা সারা বছর সবজি চাষ করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে। শুধু হাটচালা গ্রামের চাষীরা এবছর থেকে দেড় কোটি টাকার উচ্ছে ও করলা বিক্রি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন তাদের দেখে আবাদচন্ডীপুর, কুলতলি ও আাটুলিয়ার কিছু জায়গায় স্থানীয়রা সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

Leave a Reply