ডেস্ক নিউজ : সুন্দরবনের খালে বিষ ছিটিয়ে মাছ শিকারের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড কোনো ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবনের জলজ সম্পদ। সুন্দরবনের খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ সব অপরাধ ঠেকাতে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে সভা-সমাবেশসহ নানামুখী প্রচার চালিয়ে আসছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা জেলেদের তারা ‘বিষদস্যু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কয়রা উপজেলা উন্নয়ন সংগ্রাম ও সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সুন্দরবনে বনদস্যুরা এখন আর নেই। তবে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে বিষদস্যুতা। এই বিষদস্যুদের অপকর্মে বিষাক্ত হচ্ছে সুন্দরবনের সামগ্রিক পরিবেশ। বেসরকারি সংস্থা প্রতিবেশ কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনের পেশাজীবী ও অপরাধ দমন নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটির সমন্বয়ক আলাউদ্দিন আলী অভিযোগ করেন, সুন্দরবনের সব খাল এখন অপরাধীদের দখলে চলে গেছে। এমনকি প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকায়ও অবাধে অপকর্ম চালাচ্ছে তারা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বন বিভাগের নজরদারি কমে আসায় অপরাধ আরও বেড়েছে।
সুন্দরবন বনজীবী ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে জেলেদের দিয়ে অবৈধ কাজ করিয়ে লাভবান হচ্ছেন এলাকার কিছু প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ী। মূলত তারাই জেলেদের অপরাধমূলক কাজে উৎসাহিত করছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের লোক ও বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মী এসব ব্যবসায়ীকে সহযোগিতা করছে।
সুন্দরবনের কমিউনিটি প্যাট্রলিং গ্র“পের সদস্যরা বলছেন, দাদনের ফাঁদে ফেলে সাধারণ জেলেদের অপকর্মে জড়াতে বাধ্য করছে প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীরা। তারাই জেলেদের কাছে বিষ সরবরাহ করে। জেলেরাও কম পরিশ্রমে বেশি মাছ ধরে দাদন শোধ করতে পারায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। মাঝে মধ্যে লোকালয়ের পাশ থেকে দু-একজন ধরা পড়লেও অধিকাংশই ধরা পড়ে না। এর বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের বিকল্প নেই।
সাধারণ জেলেরা বলছেন, এলাকার দাদন ব্যবসায়ীদের নিয়োজিত জেলেদের নিয়ন্ত্রণে সুন্দরবনের সব খাল। বন বিভাগের অনুমতিপত্র থাকলেও সাধারণ জেলেরা মাত্র দু-একটি খালে মাছ ধরতে পারেন। বন বিভাগ থেকে শুরু করে এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা দাদন ব্যবসায়ীদের পক্ষে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যান না।
জানা গেছে, বর্তমানে কয়রা ও দাকোপ উপজেলার তিন দাদন ব্যবসায়ীর জেলেদের দখলে রয়েছে সুন্দরবনের বেশির ভাগ খাল। কয়রা সদর ইউনিয়নের সাবেক সদস্য আবু মুসার নিয়ন্ত্রণে আছে ভ্রমরখালী অভয়ারণ্য। দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের সাবেক সদস্য জহির উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বনের নীলকমল এলাকা। কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবু সাঈদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পাতকষ্টা অভয়ারণ্য। এ ছাড়া কয়রার মোজাফ্ফর আলী নীলকমল ও কাগাদোবেকি, আমিরুল ইসলামের পাতকষ্টা, হাবিবুল্যাহ, আজিজুল ইসলাম ও সাবেক বনদস্যু গোলাম মোস্তফা গেওয়াখালী অভয়ারণ্যের খালে জেলেদের পাঠান। এসব মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তারা দাবি করেন, বন বিভাগ থেকে মাছ ও কাঁকড়া শিকারের অনুমতি নিয়েই তারা সুন্দরবনের খালে জেলেদের পাঠান। বন বিভাগের অনুমতিপত্রে নির্দিষ্ট করা এলাকার বাইরে কোনো জেলে মাছ শিকার করেন না। তবে বনের ভেতর কী ঘটে, সে বিষয়ে তারা জানেন না।
কয়েকজন জেলে জানান, সুন্দরবনের খালে মাছ শিকারে যে বিষ ছিটানো হয় তার মধ্যে ‘রিপকড’ এর ব্যবহার বেশি। এ ছাড়া এমিস্টার, ডায়মগ্রো, ফাইটার, পেসিকল নামের কীটনাশকও ব্যবহার করেন তারা। এসব বিষ মহাজনরাই সরবরাহ করেন তাদের। তারাই ঠিক করে দেন কোন এলাকায় মাছ শিকার করতে হবে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার সরকার বলেন, সুন্দরবনের বিষদস্যুদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। কারও একার পক্ষে এই অপরাধ দমন সম্ভব নয়। কারণ এর সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। এ বিষয় কথাহয় খুলনা রেজ্ঞের সদ্য যোদানকারী এসিএফ এমএ হাসান তিনি বলেন, আমি মাত্র যোগদান করেছি বিষয়টি আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো।
সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, খালের পানিতে বিষ ছিটিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৫ আগস্টের পর সব প্রশাসনেই কিছু অস্থিরতা চলছিল। বন বিভাগেরও বিভিন্ন স্টেশনে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে নজরদারি কমে যায়। এখন আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।
Leave a Reply