রামুতে হামলার এক যুগ, থমকে আছে বিচারকাজ

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪, ১২:০০

ভয়েজ ডেস্ক : কক্সবাজারের রামু বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলার ১২ বছরেও বিচার শুরু করা যায়নি। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন সাক্ষী দিতে না আসা এবং মামলা তদন্তে ত্রুটি থাকার কারণে বিচারকাজে বিলম্ব হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যদিও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ ঘটনায় পুলিশের করা ১৮টি মামলারই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। পুলিশ ইচ্ছেমতো আসামি করায় এসব মামলা নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনেরই আগ্রহ নেই।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধপল্লির ২৬টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। পরদিন উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রামু সদরের উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবক পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে ওই হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়।

এসব মামলায় এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামি করা হয়। পরে আপসে একটি মামলা প্রত্যাহার হলেও বাকি ১৮ মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু ঘটনার ১২ বছর পার হলেও ১৮টি মামলার একটিরও বিচারকাজ শেষ হয়নি।

রামু বৌদ্ধ যুব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়া আব্বু (এমইউপি) বলেন, রামুতে বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধপল্লিতে হামলার মামলা সম্পর্কে বৌদ্ধ সম্প্রদায় কিছুই জানে না। এসব মামলা করেছে পুলিশ। ওই সময় পুলিশ ইচ্ছেমতো আসামি করেছে, ইচ্ছেমতো বাদ দিয়েছে। পুলিশ যে অভিযোগপত্র দিয়েছে এসব বিষয়েও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন অবগত নয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। আমরা আশা করছি দীর্ঘ ১২ বছর পর হলেও রামু সহিংসতার সঠিক বিচার পাবেন ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কলেজ শিক্ষক নীলোৎপল বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমরা চাই সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ হোক। উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা—যদি এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ২৯ সেপ্টেম্বরের মতো এ ধরনের ঘটনা আর কখনো ফিরে আসবে না।

তিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন,
১২ বছর হয়ে গেল, একটি মামলারও বিচার হয়নি। শুধু রামু হামলা নয়, এরই মধ্যে এ ধরনের আরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেকটি ঘটনার বিপরীতে উপযুক্ত বিচারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও জরুরি এবং এই দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

গত ১২ বছরে গুজবের ওপর ভর করে বিভিন্ন স্থানে অনেক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যদি সহনশীল হন এবং নিজেদের বিবেচনাবোধকে কাজে লাগান তবেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

রামুর কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বলেন, রামুর ধর্মীয় সম্প্রীতি শত বছরের। এই সম্প্রীতিতে যারা আঘাত হেনেছিল তারা সফল হয়নি। যে ক্ষতের তৈরি হয়েছিল, ১১ বছরে আমরা সবাই মিলে তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। তবে দুঃখের বিষয় হলো এ হামলার ১২ বছরেও ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের সাবেক কৌঁসুলি ফরিদুল আলম বলেন, ১৮টি মামলার মধ্যে দুটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। তিনটি পুনঃতদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন মামলায় সাক্ষ্য দিতে না আসায় বিচারিক কার্যক্রমে বিলম্ব হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, রামুর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এক যুগ কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি পুলিশের দায়ের করা ১৮টি ফৌজদারি মামলার মধ্যে কোনো কোনো মামলায় পিবিআই অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও বিচার এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি।

তিনি বলেন, বিগত ২০ বছরের ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় নিলেও দেখা যাবে এ ধরনের একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। ফৌজদারি মামলার বিচার করে রাষ্ট্র, তাই এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় যদি কাউকে দিতে হয় তাহলে সেটি রাষ্ট্রের ওপরই পড়বে।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচারের ক্ষেত্রে বিগত সরকারগুলোর আন্তরিকতা ছিল না জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী বলেন, যে কারণে দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর ভুক্তভোগীদের কোনো প্রকার আস্থা তৈরি হয়নি। অন্য যে কোনো অপরাধের মতো সাম্প্রদায়িক সহিংসতারও সঠিক বিচার করা গেলে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাড়তো।

অবিশ্বাস নিয়ে পাশাপাশি চলা যায় না মন্তব্য করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিলোপের আওয়াজ উঠেছে চারদিকে, তাতে আইনি এবং বিচারিক বৈষম্যও দূর হবে, এটাই সাধারণের প্রত্যাশা। কিন্তু মৌলবাদের যে আস্ফালন দেখা যাচ্ছে তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার, যেখানে সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তোলার প্রত্যয় থাকবে।

Leave a Reply