ভয়েজ ডেস্ক : পুলিশ বাহিনীকে বিগত সরকার ব্যবহার করে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের চেষ্টা চালায়। এতে পুলিশের ওপরে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে আন্দোলনকারীদের। সারা দেশে পুলিশের ওপরে হামলা, থানায় ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন পুলিশ সদস্যরা।
বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও থানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পুলিশের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করা যায়নি। পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে সাজাতে প্রতিটির থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে পরিদর্শক (ওসি) পর্যন্ত বেশিরভাগই বদলি করা হচ্ছে। থানায় জনবল ঘাটতির পাশাপাশি বিরাজ করছে অস্থিতিশীল পরিবেশ। কমেছে থানা এলাকার টহল ও পুলিশি সেবার গতিও।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। কথা হয় থানার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে।
এই পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এখনও রাস্তায় পুলিশ সদস্যদের দেখলে মানুষ টিচ করে কথা বলে। নানা ইঙ্গিতে বিরূপ মন্তব্য করে। ফলে কোনও বিশৃঙ্খলা ঘটলে তা থামাতে বা আসামি ধরতে একাধিক পুলিশ সদস্যকে যেতে হচ্ছে। জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার চেয়ে নিজেদের নিরাপত্তাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
সরেজমিন দেখা যায়, থানার সামনে তিনটি টহল গাড়ি রাখা আছে। এক পাশে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মোটরসাইকেল ও গাড়ি । মূল ফটকে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা বেষ্টনী। ভবনের ভেতরে পুলিশের উপস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় কম। তবে অভিযোগ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের আনাগোনা বেশি। থানা এলাকায় নেই টহল গাড়িও।
জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় কম্পিউটার না থাকায় অভিযোগ গ্রহণে হিমশিম খাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। শেরেবাংলা নগর থানার আশপাশে কয়েকটি বস্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট রয়েছে। আগারগাঁও ও রাজাবাজার এলাকা এই থানার অধীন। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিয়ত এসব এলাকায় চুরি, দখল, মাদক কারবার, পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব নিয়ে থানায় আসছেন সেবাগ্রহীতারা। কিন্তু পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তা না থানায় দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
থানা সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট এ থানায় ভাঙচুর ও লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। সেরেস্তা কক্ষে আগুন দেওয়ায় সেখানে থাকা খতিয়ান, তদন্ত বই, রিসিভ ডিসপাসসহ রেজিস্টার বই ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার কাগজপত্র পুড়ে যায়। থানার ভেতরে থাকা চারটি টহল গাড়িসহ ৭টি গাড়ি, ১৮টি মোটরসাইকেল, ৬টি কম্পিউটার, ৬টি প্রিন্টার, ১৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা, ৯৫টি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, ৪০টি হেলমেট, ১০২টি হ্যান্ডকাফ, ১৮টি ওয়্যারলেসসহ জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
নাম প্রকাশ না করে একজন উপ-পরিদর্শক জানান, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনও ভয় বিরাজ করছে। কিছু মানুষ পুলিশকে মেরে পরিবেশ ঘোলা করার চেষ্টা করছেন। যারা ৫ আগস্টের আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগ ঢাকার বাইরে এবং ঢাকায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে বদলি করা হয়েছে। এখনও পুলিশের ওপরে সাধারণ মানুষের মাঝে কিছুটা ক্ষোভ দেখা যায়। এসব বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।’
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোকাম্মেল হক বলেন, ‘৫ আগস্টে থানায় হামলা ও লুটপাটে অনেক লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ইকুইপমেন্ট খোয়া গেছে। পুড়েছে একটি কক্ষ। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে থানার ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরে রিকুইজিশন দেওয়া হয়েছে। এসব সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি নতুন অফিসাররা যোগদান করলে এবং প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়া হলে কাজের গতি বাড়বে।’
ওসি আরও বলেন, ‘থানায় পুলিশ অফিসারের সংকট আছে। তাই থানার বিট অনুযায়ী এখনও টহল পুলিশ ও ফোর্স দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া অনেকের বদলির অর্ডার হয়ে আছে। ফলে তাদের মামলার তদন্তের দায়িত্বও দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া জনতার মব তৈরির কিছুটা ভয়তো আছেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি পুলিশ সদস্যদের সাহস জোগাতে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে।’
থানা এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়া পর রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। এদিন বিকাল ৩টার দিকে আদাবর থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আদাবর থানার ২০ থেকে ২৫ জন পুলিশ সদস্য প্রাণভয়ে পালিয়ে শিশু হাসপাতালের সামনের সড়কে চলে আসে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সেখানে আবারও তাদের ওপর হামলা হয়। তখন প্রাণ বাঁচাতে সেখানে প্রায় আধঘণ্টা ধরে তারা গুলি ছোড়ে। পুলিশের ওপরে হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে থানা ভবন ছেড়ে চলে যায় শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। বিকাল ৫টার দিকে আদাবর থানা থেকে আসা পুলিশ সদস্যরা শেরেবাংলা নগর থানায় ঢুকে আশ্রয় নেন। সেখানেও তাদের ওপরে হামলা চালায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা। তখন থানার সামনে জড়ো হওয়া জনতার দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে পুলিশ এবং তারা ৬০ ফিট ভাঙা মসজিদের দিকে পালিয়ে যায়। এসময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হন। এসব তথ্য জানান শেরেবাংলা নগর থানার গাড়িচালক লিমন।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আয়নাল বলেন, আদাবর থানা থেকে পালিয়ে আসা ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য মিরপুরের দিকে চলে যাওয়ার পর ১০ থেকে ১৫ জন লোক থানায় ভেতরে ঢোকে। তারা বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভাঙচুর করে। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে আবারও কয়েকজন এসে থানার দ্বিতীয় তলায় সেরেস্তা (মামলার নথিপত্র) কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় থানার ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি কম্পিউটার লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পুলিশের ওপর হামলা ও গোলাগুলির সময়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বাইরের মানুষও ছিল। তবে থানায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি। যাদের বেশিরভাগ চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত।
Leave a Reply