ভয়েজ ডেস্ক : “ঘেরের অনেক মাছ, গলদা চিংড়ি, সব পানিতে ভাঁসায় নিয়ে গেছে। অনেক টাকা খরচ করিছি। এখন এই যে ক্ষতি, কিভাবে পুষাবো জানিনে? এখন আমাদের এই দুরাবস্থা! চিন্তায় ঘুমোতে পারিনে। এখন যে কি করব? বুঝে উঠতে পারতিছিনে। আমাদের প্রতিবছর এইভাবে বিল তলায় যাচ্ছে। গত বছরও আমার অনেক মাছ চলে গেছে। এই বছরও সেই একই অবস্থা। প্রত্যেকটা ঘেরের এমনই অবস্থা। সব ঘের তলায় গেছে। বাকি যেটুকু আছে, ডাঙ্গার পানি বিলে ঢুকলে সেটুকুও আর থাকবে না। বিলের পানি সরানোর কোন জায়গা নেই। যে একটা জায়গা আছে সেটা কচুরিপানা দিয়ে আটকানো। পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা এখন খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি”।
গত তিন দিনের ভারি বর্ষণে নিজের ঘেরের লাখ লাখ টাকার গলদা চিংড়ি পানিতে ভেঁসে যাওয়ায় এভাবে নিজের সর্বনাশ এবং অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করছিলেন আড়ংঘাটা থানাধীন তেলিগাতী গ্রামের বিল ডাকাতিয়ার মাছ চাষী মোঃ আকবর শেখ। কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে তার ঘের থেকে কয়েক লক্ষ টাকার গলদা চিংড়ি পানিতে ভেসে যাওয়ায় পাগল প্রায় আকবর শেখ।
শুধু আকবর শেখ নয়, গত ৩ দিনের ভারী বর্ষণে বিল ডাকাতিয়ার তেলিগাতী মৌজার সহস্রাধিক মাছ চাষীর ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেঁসে গেছে কোটি কোটি টাকার চিংড়ি এবং সাদা মাছ। ঘেরের মাছ ভেঁসে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে এ সকল মাছ চাষীরা।
তেলিগাতী গ্রামের মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান। বিল ডাকাতিয়ার অন্যতম বড় একজন মাছ চাষী। খুলনা গেজেটকে তিনি বলেন, “এক সময় এই বিল ডাকাতিয়া আমাদের জন্য খুব একটা আশীর্বাদের জায়গা ছিল। এখন যে পরিস্থিতি হইছে, বিগত দুই বছর ধরে, এটা আমাদের জন্য দুঃস্বপ্ন বলেন, দুর্ভিক্ষ বলেন এইরকম একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। আমরা এখানে যারা মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল, আমরা সবাই পানিতে প্লাবিত। অনেক ক্ষতি হইছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির মাছ এখন ফুটফুটে পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
উন্মুক্ত বিলে মানুষ মাছ শিকার করছে আর মাছ চাষীরা কেঁদে মরতিছে। এক কথায় কান্না করছে। বিল ডাকাতিয়া প্লাবিত হওয়ার ফলে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমার নিজেরও তিনটা ঘের প্লাবিত হইছে। কয়েক লাখ টাকার মাছ ভেঁসে গেছে। এখানে সরকারি কিছু চিংড়ি মাছের প্রকল্প আছে। সেগুলোও প্লাবিত হয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকারি প্রকল্পগুলোতে মাছ দিল, খাবার দিল, কিন্তু তারা পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা করল না? তিনি বলেন, এ জলাবদ্ধতার কারণ হচ্ছে বিগত দিনে যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন, যারা ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন তারা কখনও পানি নিষ্কাশনের ব্যাপারটা মাথায় রাখিনি। কখনও তারা ডাকাতিয়া বিলের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। এখন সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি আমাদের দান খয়রাত বা যাকাত লাগবে না। আমাদের একটাই দাবি বিল ডাকাতিয়ার পানির নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক”।
বিল ডাকাতিয়ার মাছ চাষী তেলিগাতী গ্রামের আসলাম বলেন, “প্রতি বছর আমাদের এই ঘের বেঁড়ি তলায় যায়। ঘেরের উপর হাঁটু সমান পানি। ঘেরের পাড়ে ঝালের চারা লাগাইছিলাম এখন উঠোই নিয়ে যাচ্ছি। ঘেরের মাছ সব চলে যাচ্ছে। নেট দিছি, তাও ঠ্যাক খাচ্ছে না। নেটের উপর দিয়ে লাফায় চলে যাচ্ছে। বিলের পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা নেই। প্রতিবছর তলায় যায়। ক্ষ্যাতখন্দ হয় না। আমরা মাছ চাষীরা হয়রানি হয়ে যাচ্ছি”।
একই এলাকার মাছ চাষী রিজাউল ইসলাম বলেন, “এক সময় বিল ডাকাতিয়া আমাদের জন্য আশীর্বাদ ছিল। এখন আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াইছে। আমাদের এখান থেকে কোন উৎপাদন হচ্ছে না। প্রতিবছর তলায় যাচ্ছে। এভাবে প্রতিবছর আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঘের বেড়ি উঁচু করলেও থাকে না। পানি না সরার কারণে”।
উল্লেখ্য, বিল ডাকাতিয়া এক সময় হাজার হাজার কৃষিজীবী এবং মৎস্য চাষীদের জন্য আশীর্বাদ ছিল। ৮০’ দশকেও বিলটিতে প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে বছরে ৩টি ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে মাছ চাষ হতো। তখন কৃষিজীবী এবং মাছ চাষীদের মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকতো। বিল ডাকাতিয়ার পানি নিষ্কাশনের জন্য সুইচ গেট এবং খাল খনন করা হয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় পানি নিষ্কাশনের খালগুলি নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলবদ্ধতার। আশীর্বাদের সেই বিল ডাকাতিয়া এখন কৃষিজীবী ও মৎস চাষীদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণের ফলে বিল ডাকাতিয়া প্লাবিত হয়। প্লাবিত হয় হাজার হাজার কৃষিজীবী এবং মাছ চাষীদের স্বপ্ন। বিশেষ করে প্রতিবছর বিল ডাকাতিয়ার হাজার হাজার মাছ চাষী ঘেরে মাছ দিয়ে লাভের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু পানি নিষ্কাশন না হাওয়ায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণ হলেই তাদের সে স্বপ্ন পানিতে তলিয়ে যায়।
গত ৩ দিনের ভারী বর্ষণে বিল ডাকাতিয়ার তেলিগাতী মৌজার কয়েক হাজার মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে ক্ষেতের ফসল। সর্বনাশ হয়েছে মাছ চাষীদের। উদ্বিগ্ন এবং হতাশ হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের মাছ চাষিরা।
Leave a Reply