শ্যামনগরে লবণাক্তার প্রভাবে বাধ্য হয়ে কৃষিকাজ ছাড়ছেন কৃষক

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ২, ২০২৪, ১১:৫৫

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : লবণাক্ততার প্রভাবে দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদের আবাদি জমি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ কৃষি জমি চাষাবাদের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। কোনো কৃষি জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করলে পরববর্তী কয়েক বছর সেখানে কোনো ফসল হয় না। তাই বাধ্য হয়ে কৃষকরা পতিত জমি পরিত্যক্ত ঘোষণা করছেন। অনেকে আবার ওই জমিতে ঘের তৈরি করছেন।

জেলায় লবণাক্ততায় শীর্ষে রয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর অঞ্চল। সুন্দরবন বেষ্টিত এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও মৎস্য খাত থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষি আবাদি জমি চাষের অনুপোযোগী হওয়ায় অনেকেই ইতোমধ্যে কৃষি পেশা পরিবর্তন করেছেন।

অন্যদিকে, কৃষি জমির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় জনপদের গাছপালাসহ অন্যান্য উদ্ভিদ। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের গাছের ওপর ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। পাশাপাশি এই প্রভাব গবাদি পশু থেকে শুরু করে মানুষের ওপরেও বিস্তার লাভ করেছে।

 

ভুক্তভোগী এই জনপদের বাসিন্দাদের ভাষ্য মতে, বছরের বেশিরভাগ সময় লবণ পানি সহজে প্রবেশ করতে পারে এই অঞ্চলের কৃষি জমিতে। ফলে জমিতে লবণাক্ততার প্রভাব থেকে যায় কয়েক বছর। বাধ্য হয়ে অনেকে কৃষি জমিকে পরিণত করেছেন মৎস্য ঘেরে। তাছাড়া গরু-ছাগলসহ অন্যান্য গবাদি পশু পালন করাটাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কারণ এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায় গবাদি পশু পালনের সুবিধা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি, উপকূলীয় এলাকার পতিত জমিতে লবণ সহিষ্ণু জাতের ধান ও সবজি চাষের আওতায় আনা হয়েছে যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সেটার প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাতক্ষীরার ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্য ৮১ শতাংশের বেশি অর্থাৎ ১ লাখ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর কৃষি জমি লবণাক্ততার প্রভাবে অকৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে পতিত জমি রয়েছে ৪০ হাজার ১০১ হেক্টর।

লবণ পানির প্রভাবে ক্ষতিতে শীর্ষে রয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় সুন্দরবন অঞ্চল। এই জনপদের ৩৭ হাজার ১৪৬ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬ হাজার ৯১০ হেক্টর জমি লবণাক্ততায় রূপ নিয়েছে।

তাছাড়া সদর উপজেলায় ২৯ হাজার ৩১৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৬৩ শতাংশ, কলারোয়ায় ১৭ হাজার ৪২১ হেক্টর জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ, তালায় ২৮ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমির ৬৪ শতাংশ, দেবহাটায় ১৪ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমির ৬১ শতাংশ, কালীগঞ্জে ২৬ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জমির ভেজতে ১৬ শতাংশ ও আশাশুনি উপজেলায় ৩৪ হাজার ৪৫৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৮৭ শতাংশ জমি লবণাক্ততায় রুপ নিয়েছে।

গাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা হালিম হোসেন বলেন, প্রতি বছরই এই উপকূলীয় জনপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী থাকায় খুব সহজে লবণ পানি কৃষি জমিতে প্রবেশ করে। লবণ পানি যে বছর জমিতে প্রবেশ করে পরবর্তী তিন থেকে চার বছর ওই জমিতে আর কোনো ফসল হয় না। আমার নিজেরও কয়েকটি আবাদি জমি ছিল, কিন্তু প্রতিবছর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও লবণাক্ততার কারণে ওই জমিগুলোকে বছর চুক্তিতে অন্যকে দিয়েছি। সেখানে বর্তমানে চিংড়ি ঘের করেছে। আমার মতো শত শত কৃষক এই অঞ্চলে রয়েছে যারা বর্তমানে কৃষি পেশা পরিবর্তন করেছে।

উপকূলীয় পাতাখালী গ্রামের মাসুম বিল্লাহ বলেন, এই অঞ্চলজুড়ে এক সময় অধিকাংশ জমিই কৃষি খাতে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে জমিগুলো রূপ নিয়েছে মৎস্য ঘের আর পতিত জমিতে। এর মূল কারণ হচ্ছে কৃষি জমিতে লবণাক্ততার প্রভাব। আবার অনেকেই রয়েছেন যারা জমিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। কারণ সেখানে ঘের করার উপযুক্ত না। তাই বাধ্য হয়ে জমিতে চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছে।

রমজান নগর ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা বলেন, বাধ কেটে জমিতে লবণ পানি প্রবেশ করানোর কারণে জমির উর্বরতা হারিয়ে গেছে। যার ফলে এখন আর আগের মতো আবাদ করা সম্ভব হয় না। তাই কৃষি জমিকে ঘের ব্যবসায়ীদের কাছে বছর চুক্তিতে মৎস্য ঘের করতে দেওয়া হয়েছে। এতে করে এই অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সংকট তৈরি করেছে।

রমজান নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আল মামুন এই প্রতিবেদককে বলেন, এই ইউনিয়নজুড়ে লবণাক্ততার একটি বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। যার ফলে এখানে কিছু অঞ্চলের জমিতে লবণ পানি সহিষ্ণু ধান ও তরমুজ হয়ে থাকে। তাছাড়া অন্য কোনো ফসল এই অঞ্চলজুড়ে তেমন হয় না। অনেকেই আগে কৃষি জমিকে মৎস্য ঘেরে পরিণত করেছেন, তবে বর্তমানে সেটা কমেছে কারণ মৎস্য ঘেরে তুলনামূলক লাভ নেই।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রনী খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে লবণ সহিষ্ণু ধানের বীজ বিতরণ করা হয়। কৃষকরা সেই বীজ রোপন করে লাভবান হচ্ছেন। লবণ সহিষ্ণু এই অঞ্চলের জন্য শাক সবজিসহ ধানের বীজ আলাদাভাবে বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত এই অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব বেশি থাকায় এখানে অন্য অঞ্চলের শাকসবজিগুলো হয় না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে লবণ সহিষ্ণু বীজ বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ঘের ব্যবসাতেও তেমন লাভ নেই। তাই কৃষকরা নতুন করে তাদের জমিকে ঘেরে পরিণত করছে না।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ির) উপ-পরিচালক এই প্রতিবেদককে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কৃষি আবাদ যোগ্য জমির মাঠের চারপাশজুড়ে উঁচু করে বাধ দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে করে পার্শ্ববর্তী নদ-নদী থেকে লবণ পানি সহজে কৃষি জমিতে প্রবেশ করতে না পারে। উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলের জন্য ধানের ছয় থেকে সাতটি জাতের বীজের গবেষণা চলমান রয়েছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলে ধানগুলো চাষাবাদ করে কৃষকরা বেশ লাভবান হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে এখানে অন্য কোনো শাকসবজি সহজে চাষাবাদ করা সম্ভব না। তবে বৃষ্টিকালীন সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির শাকসবজি চাষাবাদ করা যায়। কারণ বৃষ্টির পানিতে লবণাক্ততা ধুয়ে চলে যায়। এ সময় কৃষকরা কিছু অংশে শাকসবজি চাষাবাদ করে থাকেন।

Leave a Reply