শ্যামনগরে নরম খোলসের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে বহির বিশ্বে

প্রকাশিতঃ নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ১৩:১২

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরা শ্যামনগরে খোলস দেওয়া নরম কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, জার্মান, চীন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে সাতক্ষীরা থেকে : সুন্দরবনের মাছ, কাঠ ও মধু সংগ্রহ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন সাতক্ষীরার উপকুলীয় এলাকার মানুষ। হিংস্র বাঘ আর ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই পরিবারের সদস্যদের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতেন তারা। এর মধ্যে বর্ষা মৌসুমে ভেড়িবাঁধ ভেঙে বাড়ি ঘর প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে এমন বৈরী পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করলেও বছরের অধিকাংশ সময় বনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পেশা নিয়ে শংকিত ছিল শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তবে সফটসেল বা নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে পাল্টে গেছে জীবন যাত্রা। জেলার উপকূলে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কাঁকড়া চাষ। লোনা পানি ও আবহাওয়া কাঁকড়া চাষের উপযোগী হওয়ায় প্রতিবছরই বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে এর চাষ। সাদাসোনা খ্যাত বাগদা চিংড়িতে মড়ক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ বিভিন্ন কারণে মাছ উজাড় হয়ে যাওয়ার ফলে এ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেক চাষি। তবে একই জমিতে কাঁকড়ার পাশাপাশি সাদা মাছ চাষ করা সম্ভব বলে আগ্রহ বাড়ছে তাদের। করোনাকালীন সময়ে বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় অনেক চাষি চাষ বন্ধ করে দেয়। তবে আবারো রপ্তানি শুরু হওয়ায় এ চাষে আগ্রহ বাড়ছে অনেকের। পোনা পর্যাপ্ত উৎপাদন হলে জেলায় কাঁকড়া চাষের সম্ভাবনা আরো বাড়বে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। জানা গেছে- চিংড়িতে ভাইরাস, রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমায় অধিকাংশ চিংড়ি চাষি এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া উৎপাদনে প্রতি বছর সাতক্ষীরায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার। বেকার যুবকরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অনেকেই দেখছেন সফলতার মুখ। জানা যায়- ২০১৪ সালে জেলায় বানিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ হয়েছিল মাত্র ৫০ হেক্টর জমিতে। বর্তমান চাষ বেড়েছে ৬ গুনের বেশি। সাতক্ষীরা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে- উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনিসহ বিভিন্ন উপজেলায় এ বছর কাঁকড়া চাষ হয়েছে ৩১৪ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৪ টন। এদিকে ছোট কাঁকড়ার রেণু সংগ্রহের একমাত্র উপায় সুন্দরবনের নদী। কিন্তু বছরের প্রায় ৬ মাস সুন্দরবনে প্রবেশে জেলেদের নিষেধাজ্ঞা থাকে। কাঁকড়ার আয়ুস্কাল কম থাকায় সে সময় নদীতে উৎপাদিত এসব রেণু মারা যায়। এতে চাষযোগ্য রেণু সংগ্রহে বাধাগ্রস্ত হন চাষিরা। নিষেধাজ্ঞায় রোজগার বন্ধ থাকলে পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে অনেকের। এ ধরনের প্রতিকূল সময়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ। এতে অনেকের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। বিদেশে রপ্তানির সুযোগ থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় শ্যামনগরের মানুষ এখন নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে ঝুঁঁকছেন। এ খাত থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করেন অনেক পরিবার। আরো জানা যায় ২০১৪ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে উপকূলে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ শুরু হলেও চাষিদের প্রশিক্ষণ না থাকায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অনেকের আবার আর্থিক সংকটও ছিল। এ সময় চাষিদের আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। তবে বছরের প্রায় অর্ধেক সময় সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণের পাস বন্ধ থাকে। এতে করে সফটসেল কাঁকড়া চাষের প্রধান কাঁচামাল হার্ডসেল কাঁকড়া বা ক্রাবলেটের স্বল্পতার দেখা দেয়। ফলে বেশি মূল্যে ক্রাবলেট ক্রয় করতে হয় চাষিদের। বৈশ্বিক মন্দা আর উৎপাদন খরচ অনুযায়ী মূল্য না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন চাষিরা। তারা জানান- সম্ভাবনাময় সফটসেল কাঁকড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সুন্দরবনের উপর নির্ভশীলতা কমিয়ে বিকল্প উপায়ে স্বল্পমূল্যে পোনা সরবরাহের পাশাপাশি চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। চাষিরা জানান, বাজার থেকে কাঁকড়া কিনে ছোট খাঁচায় রেখে মোটাতাজা করা হচ্ছে। ২০ থেকে ২২ দিনেই একবার খোলস পরিবর্তন করে এরা। এতে প্রতিটি কাঁকড়ার ওজন বেড়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়। পরে এই কাঁকড়া রপ্তানি হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। লাভ বেশি ও রোগবালাই কম হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে খাচায় কাঁকড়া চাষ পদ্ধতি। এক হাজার বক্স নিয়ে কাঁকড়ার চাষ শুরু করেন শ্যামনগরের লক্ষী পদ। তিনি বলেন, খাঁচায় চাষকৃত কাঁকড়ার খোলস নরম থাকে। এ কারণে বাজার চাহিদাও বেশি। সাতক্ষীরায় উৎপাদিত এসব কাঁকড়া প্যাকেটজাত করে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। দামও পাওয়া যায় ভালো, কেজি প্রতি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি জানান- প্রতিদিন বাজার থেকে ছোট সাইজের কাঁকড়া কিনে খাচায় রেখে মোটাতাজা করা হয়। খাঁচার কাঁকড়ার খাবার হিসেবে তারা প্রতিদিন ছোট ছোট তেলাপিয়া মাছ দেয়া হয়। শ্যামনগরের কাকড়া চাষি আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম আবু জানান, মোটাতাজা করার জন্য প্রয়োজনীয় রেণু কাঁকড়ার দাম অনেক বেড়েছে। এতে লাভ অনেকাংশে কমে গেছে। আগে রেণুর কেজি ছিল ১০০ টাকা। বর্তমানে দাম বেড়ে ৩০০-৪০০ টাকা হয়েছে। তিনি আরো জানান, শক্ত খোলসের কাঁকড়া ধরে প্রথমে দুটি কানসহ ৬টি নলি (হাত-পা) কেটে লোনা পানির প্লাস্টিকের বক্সে রাখা হয়। দেয়া হয় খাবার। বক্সে রাখার ৩ ঘণ্টার মধ্যে কাঁকড়াটি শক্ত খোলস পরিবর্তন করে নতুন খোলস নেয়। সে সময় কাকড়াটি একেবারে নরম থাকে। ৩ ঘণ্টার মধ্যে ওই কাঁকড়া তুলতে না পারলে পুনরায় শক্ত খোলসে পরিণত হয়। সে কারণে প্রতি ৩ ঘণ্টা পর পর একজন চাষিকে প্রতিটি বক্স চেক করতে হয়। শক্ত কাঁকড়া ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। শক্ত থেকে নরম খোলসে পরিণত করার পর ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। বিশ্বনাথ মণ্ডল ৫৫ হাজার বক্স নিয়ে নরম খোলসের খামার গড়ে তুলেছেন। এতে আর্থিকভাবে সাবলম্বী তিনি। তিনি জানান- সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞায় রেনু সংগ্রহ করা কঠিন। নিষেধাজ্ঞা দুই মাস পর পর হলে রেণু সংগ্রহ সহজ হবে। খুলনা বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এ বি এম জাকারিয়া জানান, খুলনা বিভাগের মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৬৭ টন কাঁকড়া রপ্তানি করে ৬৭ লাখ ৩৫ হাজার ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫১৮ টন রপ্তানি করে ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮০২ টন রপ্তানি করে ১ কোটি ১৬ লাখ ৫১ হাজার ডলার ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬২২ টন রপ্তানি করে ৮৬ লাখ ৯৮৮ ডলার আয় হয়েছে। ২৩-২৪ অর্থ বছরে ৯২৫ মেট্রিক টন রপ্তানি করে ১১৬৭ লাখ ডলার আয় হয়েছে ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন , ইতোমধ্যে সাতক্ষীরার উপকূলে বেসরকারিভাবে দুইটি ও কক্সবাজারে সরকারিভাবে একটি কাঁকড়া হ্যাচারি স্থাপন করা হয়েছে। এতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সফটসেল কাঁকড়া চাষে পোনার যে সমস্যা ক্রাবলেটের মাধ্যমে তা সমাধান হবে বলে। নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ লাভজনক। বিভিন্ন দেশে এটি রপ্তানি হয়। তাই শ্যামনগরের অনেক মানুষ এই কাঁকড়া চাষ করছেন। তিনি বলেন, সাতক্ষীরা কাঁকড়া চাষের জন্য সম্ভাবনাময়। সফটশেলের চাহিদা বেশি। কাঁকড়া প্রসেসিং প্ল্যান্ট রয়েছে শ্যামনগরে, এর মাধ্যমে কাঁকড়া সরাসরি বিদেশে যাচ্ছে। তবে সমস্যা হলো পোনা নিয়ে। পোনা সবই সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা হয়। বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও জুন-জুলাইয়ে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকে। তখন পোনা সংকটে পড়েন চাষিরা। তাই হ্যাচারি স্থাপন প্রয়োজন। সরকারিভাবে দেশে শুধুমাত্র কক্সবাজারে হ্যাচারি রয়েছে। আমরা বেসরকারিভাবে হ্যাচারি স্থাপনে উৎসাহ চাষিদের উৎসাহ দিচ্ছি।

Leave a Reply