মাদার সঙ্কটের চিংড়ি রেণু পোনা উৎপাদন ব্যহত হাবার আশংঙ্খা

প্রকাশিতঃ নভেম্বর ২১, ২০২৪, ১১:৫১

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ২০২৫ সালের মৌসুমের শুরুতে লুমিনেসেন্স ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত ও ‘মাদার’ চিংড়ি না পাওয়ায় প্রভাব পড়তে পারে চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারী শিল্পে। চাহিদা অনুযায়ি পোনা উৎপাদন না হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছে সনাতন পদ্ধতির চিংড়ি চাষ। বিদেশ থেকে আমদানি করা ‘মাদার’ দিয়ে সীমিত পরিসরে (এসপিএফ) পোনা উৎপাদিত হলেও তা একেবারেই অপ্রতুল। তবে এসব পোনা সনাতন পদ্ধতির চিংড়ি চাষে ব্যবহার যোগ্য নয়।সুত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর থেকে ‘মাদার’ চিংড়ি ধরে পোনা উৎপাদন পুরোদমে শুরু হতে আরো অন্তত ৪ মাস সময় অতিবাহিত হবে। যার ফলে চিংড়ি চাষীরা যথাসময়ে পোনা না পেয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়তে পারে। একই সাথে হ্যাচরি শিল্পও লোকসানের মুখে পাড়ার আশংকা সৃষ্টি হতে পারে। কক্সবাজারে টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০ হ্যাচারিতে চলতি মৌসুমে। (ডিসেম্বর-জুন) বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৫০০ কোটি। এখন উৎপাদন হতে পারে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম।শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সেব) মহাসচিব মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরুতে লুমিনেসেন্স ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় কোটি-কোটি চিংড়ি পোনা সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে মৌসুমের শুরুতেই পোনা উৎপাদন থমকে দাড়াবে। গত মৌসুমে চিংড়ি হ্যাচারি গুলোতে প্রায় ৫০০ কোটি পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ৩১ মার্চ পর্যন্ত চার মাসে উৎপাদন হয়েছিল ২৫০ কোটি পোনা। এ কারণে বাজারে সংকট তৈরি হওয়ায় অনেকে চোরাই পথে নিম্নমানের পোনা দেশে নিয়ে এসে বিক্রি করছিল। চোরাই পথে আসা এসব নিম্নমানের পোনার কারণে চিংড়ি চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, দেশের ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৯৬ হেক্টর জমিতে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা দিয়ে চিংড়ি চাষ হয়। কক্সবাজারের হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা সরবরাহ করা হয় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের নানা অঞ্চলে। কক্সবাজারে উৎপাদিত পোনার উপরই অনেকটা নির্ভরশীল চিংড়ি চাষীরা।একজন হ্যাচারী মালিক জানিয়েছেন, মা চিংড়ির ডিম থেকে পোনা সৃষ্টি হতে সময়ের প্রয়োজন হয় ৩০ দিন। এরপর ২৫ দিনের মধ্যে ওই পোনা ঘেরে ছেড়ে দিতে হয়। বিলম্ব হলে পোনা মারা যায়। কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত দামে মা চিংড়ি কিনে কিছু হ্যাচারি পোনা উৎপাদন করছে। তার ওপর ডিজেল-বিদ্যু, পোনার খাদ্যের দাম ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে হ্যাচারিতে পোনার উৎপাদন খরচও বেড়েছে অনেক। তারপরও চাষিদের কথা বিবেচনা করে হ্যাচারিগুলোতে পোনা উৎপাদন বন্ধ করা হয়নি। কিন্তু চোরাই পথে আসা নিম্নমানের পোনা বাজার পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। অনেক চাষী চোরাই পথে আসা নিম্নমানের পোনা প্রজেক্টে দিচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
চাষীরা। শ্যামনগর চিংড়ি চাষী সরওয়ার আজিম বলেন, আমার প্রজেক্টে মৌসুমে অন্তত ৩০ লাখ পোনা দিতে হয়। যার সবকটিই কক্সবাজারের হ্যাচারীতে উৎপাদিত পোনা। গত মৌসুমে ৩০ লাখের বিপরীতে পোনা দিতে পেরেছি মাত্র ১৫ লাখ। প্রজেক্টের আনুসাঙ্গিক ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। পোনা দিতে না পারায় বড় ধরণের লোকসানে পড়ব বলে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি।একই আশংকা করলেন পাতাখালির বেলাল উদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে তেমন কোন পোনা নেই। বিগত সময়ে খাল-নদী থেকে বিপুল পোনা ধরা হলেও এখন তা নেই। বিভিন্ন বাধার কারণে অনেকেই পোনার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। যার ফলে হ্যাচারীতে উৎপাদিত পোনার উপরই অনেকটা নির্ভরশীল চাষীরা। কিন্তু মৌসুমের শুরু থেকেই যে পোনার সংকট সৃষ্টি হবে তা কেটে উঠার সম্ভবনা তেমন একটা নেই।জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, চিংড়ি পোনায় যাতে ভাইরাস আক্রান্ত না হয় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে চোরাই পথে চিংড়ির পোনা আসার খবর তাঁর জানা নেই।
পোনা উত্পাদনকারী হ্যাচারিতে মাদার (মা বাগদা চিংড়ি) সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করায় গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশের সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি শিল্প। সমুদ্র থেকে মাদার চিংড়ি আহরণকারী জাহাজ থেকে গত ১৫ দিন ধরে কক্সবাজারভিত্তিক গড়ে ওঠা হ্যাচারিগুলোতে মাদার সরবরাহ করা হচ্ছে না। ফলে প্রয়োজনীয় মাদার না পেয়ে পোনা উত্পাদনে যেতে পারছে না কক্সবাজারের অধিকাংশ হ্যাচারি। এদিকে কক্সবাজারের অধিকাংশ হ্যাচারিতে বাগদা চিংড়ি পোনার উত্পাদন না হওয়ায় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ আশপাশের এলাকায় পোনা সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পোনার দামও বৃদ্ধি পাবে কয়েক গুণ। এতে মৌসুমের শুরুতেই পোনা সংকটের কারণে চাষিরা তাদের ঘেরে পোনা ছাড়তে বিলম্ব হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘেরে পোনা ছাড়তে না পারলে মোটা অঙ্কের টাকা লোকসানের মুখে পড়তে হবে চাষিদের। ব্যাংক লোন নিয়ে যারা চিংড়ি চাষ করেন তারা পড়বেন বিপাকে।সাতক্ষীরার চিংড়ি ঘের মালিক খায়রুল মোজাফ্ফর মন্টু বলেন, বাজারে পোনা সরবরাহ কম হলে দাম বেড়ে যায়। গত বছর ১ হাজার টাকায় পোনা কিনতে হয়েছিল। এমনিতে মড়কের কারণে আমরা চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত, এরপর সেব নিজেদের স্বার্থে এভাবে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে ঘেরে পোনা ছাড়তে না পারলে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হব। সাতক্ষীরা জেলা চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ আবুল কালাম বাবলা বলেন, ‘বাজারে পোনার সংকট হলে দাম বেড়ে যায়। ফলে চাষিদের ঘেরে পোনা ছাড়তে হিমশিম খেতে হয়। এতে চিংড়ির উত্পাদনও কমে যাবে। একই সঙ্গে কমে যাবে রপ্তানি।’ তিনি বাজারে মানসম্মত পোনা সরবরাহ নিশ্চিত করতে মাদার সরবরাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।সাতক্ষীরাস্থ দিপা সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীন বন্ধু মিত্র বলেন, ‘দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ আসে চিংড়ি রপ্তানি থেকে। পোনা সংকটের কারণে চিংড়ির উত্পাদন কম হলে রপ্তানিও কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপর। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিংড়ি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।’নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেব)-এর একজন সদস্য জানান,২০২৫ সালের মাদার সাপ্লাই পাইতে ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময় লাগতে পারে। যে কারণে অধিকাংশ হ্যাচারি পোনা উত্পাদনে যেতে পারবে না। মাদার সাপ্লাইকারী জাহাজ ব্যবসায়ী, মাদার বহনকারী কার্গো অ্যাসোসিয়েশন ও ফিড ব্যবসায়ীর সঙ্গে সেব-এর কয়েক জনের যোগসাজশে পুরো ব্যবসাটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। তারা কোটা করে প্রতিটি মাদারে কমিশন নেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে হ্যাচারিতে মাদার সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। যে কারণে কক্সবাজার ভিত্তিক ৫৬টি হ্যাচারির মধ্যে বর্তমানে চালু আছে মাত্র ২৩টি। তিনি আরো বলেন, এভাবে ৪ মাস মাদার বন্ধ থাকার কারণে চাষিরা আগামী চার মাস পোনা পাবে না। ফলে বাজারে পোনা সরবরাহ না হলে ঘের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।মত্স্য অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক রাজকুমার বিশ্বাস জানান, বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৯৬ হেক্টর আয়তনের জমিতে ১ লাখ ১১ হাজার ৯৪০ চিংড়ি ঘের রয়েছে। প্রতি মৌসুমে এসব ঘেরে মোট পোনার চাহিদা রয়েছে ৩৫১ কোটি। সেব যদি কোটার মাধ্যমে বাজারে পোনা সরবারহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে তাহলে এই অঞ্চলে পোনা সংকটের সৃষ্টি হবে। ফলে ঘেরে পোনা ছাড়তে না পেরে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাছের উত্পাদনও কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো চিংড়ি শিল্পের ওপর। শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেব)-এর মহাসচিব নজিবুল ইসলাম বলেন, মাদার (মা বাগদা চিংড়ি) সরবরাহ বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘হ্যাচারিগুলোতে মাদার না থাকায় এখন স্টকিং করা যাচ্ছে না। যে কারণে জাহাজগুলো মাদার আহরণ না করে সাদা মাছ আহরণে চলে গেছে। এছাড়া তারা মাদারের দামও একটু বাড়ানোর কথা বলেছে। আমরা বলেছি, তারা এলে এ ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।’সাতক্ষীরা, খুলনা, ও বাগেরহাটে প্রতিবছর ৪০০ কোটি বাগদা রেনুপোনা প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ৩৫০ কোটি রেনুপোনা কক্সবাজার থেকে সরবরাহ করা হয়। ৪৮কোটি সাতক্ষীরার স্থানীয় হ্যাচারি থেকে ও বাকি ২ কোটি স্থানীয় নদী থেকে রেনু আহরনকারীরা সরবরাহ করে থাকে। স্থানীয় হ্যাচারি গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্যামনগরের ওইয়াসান হ্যাচারি, নিউ যমুনা হ্যাচারি, নওয়াবেকি হ্যাচারি, রেডিয়েণ্ট হ্যাচারি ও সাতক্ষীরা বিনাপাতা হ্যাচারি।

Leave a Reply