ভয়েজ ডেস্ক : বাগেরহাট জেলা মহিলা সংস্থার সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শরীফা খাতুনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে।
ভুয়া নামে শিক্ষার্থীদের ভর্তি দেখিয়ে প্রশিক্ষণ ভাতা আত্মসাৎ, প্রশিক্ষণার্থীদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যেতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করতেন তিনি।
তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে স্বামী সন্তানসহ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি।
জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান বাগেরহাট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রী শরিফা খাতুন। এরপরেই মহিলা সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের প্রশিক্ষণ সেন্টার নেন দশানী এলজিইডি মোড়স্থ নিজ বাড়িতে, ভাড়া বাবদ বাগিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ।
বাগেরহাট শহরের আলীয় মাদরাসা সড়কে নিজস্ব জমিতে সংস্থাটির কার্যালয় রয়েছে। এই কার্যালয়ের অধীনে রাজস্ব খাতে দর্জি বিজ্ঞান, অ্যাম্বোডারি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স রয়েছে। সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান শরিফা খাতুনের দশানীস্থ এলজিইডি মোড় সংলগ্ন বাড়িতে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে রানী উদ্যোক্তাকে বিকাশ সাধন প্রকল্পের অধীনে দুইমাস মেয়াদি একটি এবং চার মাস মেয়াদি চারটি কোর্স চালু রয়েছে।
কোর্সগুলো হচ্ছে- বিউটিফিকেশন, কেটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও ফ্যাশন ডিজাইন। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু রাখতে একজন প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা, পাঁচজন প্রশিক্ষক ও একজন অফিস সহায়ক রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে প্রতি ব্যাচে দুই শিফটে ৫০ জন করে নারী প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়। দুই মাস ব্যাপী কোর্স শেষে ছয় হাজার এবং চার মাস ব্যাপী কোর্স শেষে ১২ হাজার টাকা প্রদান করা হয় প্রশিক্ষণার্থীদের। এছাড়াও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কোর্স পরিচালনা করে আসছেন তিনি। এসব কোর্সে ভর্তির জন্য কোনো টাকা না লাগলেও তিনি ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত নিতেন। আর সরকারি প্রশিক্ষণ ভাতা থেকেও একটা বড় অঙ্কের টাকা নিতেন তিনি। কোনো প্রশিক্ষণার্থী এর বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে দেওয়া হত ভয়ভীতি।
এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর গত ২৯ তারিখ জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ বিলুপ্ত করে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ভেন্যু সরিয়ে নেওয়া ও চেয়ারম্যানের বিচারের দাবিতে রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ওই বাড়িতে জড়ো হয় সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাগেরহাটে জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি অংশের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বন্ধ থাকবে এ আদেশ দেন বাগেরহাট সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি এসএম নুরুন্নবী।
এসময় জাতীয় মহিলা সংস্থা বাগেরহাটের চেয়ারম্যানের পদ থেকে শরিফা খাতুনের অপসারণ ও বিভিন্ন সময় করা দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিচার চান প্রশিক্ষণার্থীরা।
প্রশিক্ষণার্থীরা জানান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হয়েছেন শরিফা খাতুন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে এমন কোনো দুর্নীতি নেই যা তিনি করেননি। নিজের দলের লোকজনকে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে ভর্তি করানো। ভর্তির জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়া এবং প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য সরকারের দেওয়া ভাতা কেটে রাখাসহ নানা অনিয়ম করতেন। এটা নিয়ে কেউ কথা বললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত।
রুপা নামের এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, এখানে যারা প্রশিক্ষণ নিতে আসে তাদের সঙ্গে নানা অনিয়ম করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হত। সভা সমাবেশে না গেলে বাজে ব্যবহার করতেন চেয়ারম্যান শরিফা খাতুন।
মাওয়া বেগম নামের এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, মহিলা সংস্থার প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ভর্তির জন্য সরকারিভাবে কোনো ফি নেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু এখানে দুই মাসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ভর্তির জন্য ৩০০ এবং চার মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ৬০০ করে টাকা নেওয়া হত।
আনোয়ারা বেগম নামের আরেক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, এখানে মূলত দুস্থ নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও, প্রতিটি ব্যাচে বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থী থাকত শরীফা খাতুনের নিজের লোক ও দলীয় সুপারিশ প্রাপ্ত লোক। এছাড়া প্রশিক্ষণ শেষে সরকারিভাবে পাওয়া প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতা ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন অজুহাতে কেটে রাখা হত। এগুলো নিয়ে কিছু বলার সুযোগ ছিল না আমাদের।
এদিকে জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা মো. কাওছারুল হক বলেন, জেলায় আসলে রাজস্ব ও প্রকল্প দুই ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলত। রাজস্ব খাতের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গুলো প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে আমরা নিয়ন্ত্রণ করি। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে যে সব ট্রেড ছিল, সেগুলো চেয়ারম্যান নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওখানে আমার কোনো আর্থিক ক্ষমতাও ছিল না। আর চেয়ারম্যান প্রভাবশালী হওয়ার আমার সঙ্গে কখনও সমন্বয় করতেন না।
জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ উঠেছে। সেসব খতিয়ে দেখা হবে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো যাতে স্বাভাবিকভাবে চলে এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে সাবেক চেয়ারম্যান শরিফা খাতুন বলেন, যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তাদের লোকজনকেই চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমিও ছিলাম। এখন বাদ দিয়েছে, এটা নিয়ে আমার কোনো কথা নেই।
Leave a Reply