ডেস্ক নিউজ : চিকিৎসকদের পরামর্শে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন অসুস্থ খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সও ঠিক করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ডিসেম্বরের শুরুতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা হবেন খালেদা জিয়া ও তার সফরসঙ্গীরা।
সূত্র জানিয়েছে, ১ অথবা ২ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া রওনা দেবেন। এর মাধ্যমে প্রায় ৮ বছর পর লন্ডনে তার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা হবে খালেদা জিয়ার। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্সে যেতে পারেন তিনি। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পথে পবিত্র ওমরাহ পালনে সৌদি আরবেও যাওয়ার কথা রয়েছে খালেদা জিয়ার। বিষয়টি নির্ভর করবে তার শারীরিক অবস্থার ওপর। তার পরিবার ও চিকিৎসকরা এবং বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা সার্বক্ষণিকভাবে এই বিষয়টি দেখছেন। এরই মধ্যে গত আগস্টের শুরুতে নবায়নকৃত মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) খালেদা জিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও পেয়ে যাবেন খালেদা জিয়া। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে বাসায় থেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিচ্ছেন বিএনপি প্রধান। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে একটি বিশেষাষিত এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনসহ অন্তত ১৬ জনের মতো ব্যক্তি সফরসঙ্গী হবেন।
এর আগে চিকিৎসার জন্য সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই লন্ডন যান খালেদা জিয়া। প্রায় তিন মাসের বেশি সময় চিকিৎসার পর ১৮ অক্টোবর লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন তিনি। সেদিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাখো নেতাকর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত হন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। ম্যাডাম চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে একটু স্ট্যাবল আছে। দ্রুত তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হবে। সময়মতো সবকিছুই অবহিত করা হবে।’
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দির পর খালেদা জিয়ার শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দেয়। পরে বিশেষ বিবেচনায় তাকে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দফায় দফায় খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার জন্য চিঠি ও আহ্বান জানালেও তা মানেনি তৎকালীন সরকার। পরিবার থেকে সরকারের কাছে কয়েক দফা আবেদন করা হলেও অনুমতি মেলেনি। বরং খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে ফাইল ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে কালক্ষেপণ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিদেশে যাওয়ার বাধা দূর হয়েছে খালেদা জিয়ার।
জানা যায়, ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনি জটিলতা, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয় ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে খালেদা জিয়ার রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এ ছাড়া গত ২৫ জুন এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়। কয়েক দফায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন খালেদা জিয়া।
২০২১ সালের নভেম্বরে খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন চিকিৎসকরা। তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বারবার আবেদন-নিবেদন জানানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার প্রতিবারই তা উপেক্ষা করেছে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ এক নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাকে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিল।
এমন অবস্থায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের নির্দেশে খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি পান। এভারকেয়ার হাসপাতালে থেকে ওই সুসংবাদ পান তিনি। তখন এক মাস ১২ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২১ আগস্ট বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। এর পর থেকে তার চিকিৎসা বাসায় চলছে। এখন উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার চিকিৎসক বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বিদেশে নেওয়া হচ্ছে। লন্ডনেই তার পরবর্তী চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে চিকিৎসকদের সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে গত ৭ জুলাই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় বাসভবনে ফিরে আসেন। এর আগে ১৫৬ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি বাসায় ফেরেন তিনি। দীর্ঘ এই সময়ে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা এবং তার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান (সিঁথি) ঢাকার বাসায় সময় দিয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম সাত্তার বলেন, ‘ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। কীভাবে যাব এবং যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টের বিষয় আছে। সেসব বিষয়ে কাজ চলছে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে আমেরিকায় নেওয়া হবে। যেহেতু ম্যাডামকে নিয়ে মুভ করাটা কঠিন। আমরা অযথা কোথাও যাব না। আশা করি যুক্তরাজ্যেই সমাধান হয়ে যাবে। তবুও জন হপকিন্সেও কন্টাক্ট করে রেখেছি।’
প্রসঙ্গত, চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন খালেদা জিয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তিনি যাত্রাবিরতি করেন। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ই-কে ৫৮৭ ফ্লাইটে স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে দুবাই বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এ অবতরণ করেন। এ সময় তার যাত্রাবিরতির খবরে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির নেতারা বিমানবন্দরে উপস্থিত হন।
১৬ জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বেগম জিয়া লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। লন্ডনে মা-ছেলের এ সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারেক রহমান নিজের গাড়িতে করে মা খালেদা জিয়াকে গন্তব্যে নিয়ে যান। সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের সফরসঙ্গী হিসেবে তার একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার ও গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগম ছিলেন।
লন্ডন থেকে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর দেশে ফিরে ২৯ অক্টোবর কক্সবাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেখতে যান খালেদা জিয়া। সর্বশেষ তিনি জন্মদিন উপলক্ষে গুলশান চেয়ারপারসন অফিসে কেক কেটে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
জানা গেছে, কারাবন্দির পর খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি, স্মারকলিপি প্রদান, গণঅনশন, লিফলেট বিতরণ, সভা-সমাবেশসহ অসংখ্য কর্মসূচি করেছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো। খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও মুক্তির দাবিতে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর আটদিনের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। এরপর ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর সারা দেশে অনশন করেন দলটির নেতাকর্মীরা। চলতি বছরের ২৯ জুন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশসহ তিনদিনের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।
খালেদা জিয়া সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়েছিলেন। এছাড়া জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন ২০১৮ সালে। একই বছর কারাবরণের আগে ৩ ফেব্রুয়ারি হোটেল লা মেরিডিয়েনে নির্বাহী কমিটির সভায় অংশ নেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য ও মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বাংলাদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে পিজি হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) থেকে বাসায় আসেন। এরপর ১১ এপ্রিল ২০২১ কভিড-১৯ ভাইরাস পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ১৫ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করা হয়। ২৭ এপ্রিল করোনার চিকিৎসার জন্য প্রথম এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। সে বছরের ১৯ জুলাই করোনার প্রথম ডোজ টিকা এবং ১৮ আগস্ট দ্বিতীয় ডোজ ও ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় ডোজ টিকা গ্রহণ করেন। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম অপারেশন হয়। ১১ জুন ২০২২ সর্বশেষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মধ্যরাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৪ জুন হাসপাতাল থেকে বিকেলে বাসায় ফেরেন।
২০২২ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে খালেদা জিয়ার ভাড়া বাসা থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সে বছর ২৮ আগস্ট সেখানে ভর্তি হন। ৩১ আগস্ট বাসায় ফেরেন। ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আবারও তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে ২৯ এপ্রিল এভারকেয়ারে ভর্তি হন। চিকিৎসা শেষে ৪ মে বাসায় ফেরেন। ১৩ জুন রাত দেড়টায় আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া।
Leave a Reply