ভয়েজ ডেস্ক : বিসিএস অষ্টম ব্যাচের কর্মকর্তা এ কে এম মোয়াজ্জেম হোসেন। ছিলেন এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক। সিনিয়র সহকারী সচিব মর্যাদার এই কর্মকর্তা চলতি দায়িত্ব হিসেবে সংসদ সচিবালয়ে উপসচিবের কাজও করেছিলেন। ২০১৮ সালে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হওয়া এই কর্মকর্তা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ওএসডি অবস্থায় ২০২১ সালের ৩০ মার্চ মারা যান।
সব যোগ্যতা থাকার পরও তাঁকে রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাঁর পরিবারের। এ কে এম মোয়াজ্জেম হোসেনের মরণোত্তর পদোন্নতি ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে গত সপ্তাহে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী রহিমা শিকদার।
অষ্টম ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা জাকির হোসেন কামাল উপসচিব থাকাবস্থায় ২০১১ সালের প্রথম দিকেই ওএসডি হন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি পদোন্নতি-পদায়ন কোনোটিই পাননি।
এক যুগ ওএসডি থাকাবস্থায় ২০২৪ সালের ২০ মার্চ অবসরে যান। তিনিও পদোন্নতি ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। শুধু রহিমা শিকদার বা কামালই নন, তাঁদের মতো আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবার পদোন্নতি ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে অন্তত চার হাজার আবেদন জমা দিয়েছে। অনেকে বদলি-পদায়নের জন্যও আবেদন করেছেন।
সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত কমবেশি সাড়ে ছয় হাজার আবেদন জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। আগামীকাল (৩০ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত এ ধরনের আবেদন জমা নেবে সরকার।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘বঞ্চিতদের আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। এসংক্রান্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। আরো এক দিন সময় আছে ৩০ সেপ্টেম্বরের পর প্রকৃত হিসাব বলা যাবে।
কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ পাবেন বঞ্চিতরা।’
এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রশাসনে বঞ্চিত হয়েছেন এমন কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রশাসনে বঞ্চিতদের আড়াই হাজার আবেদন জমা হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে কমিটি এ তালিকা জমা দেবে। সবার আগে আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয় বিবেচনা করা হবে। যাঁরা এখনো কর্মক্ষম কিন্তু চাকরি চলে গেছে, তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে।’
সচিব পদে পদোন্নতি চেয়ে আবেদন করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান। সম্প্রতি গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পাওয়া বিসিএস নবম ব্যাচের এই কর্মকর্তা আবেদনে বলেছেন, ‘২০১৭ সালে তাঁকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গত সাত বছরেও তাঁকে সচিব করা হয়নি। তাঁকে বঞ্চিত করে তাঁর ব্যাচের তাঁর চেয়ে কম মেধাবী অন্তত ১০ জন কর্মকর্তাকে সচিব/সিনিয়র সচিব করা হয়েছে। এমনকি আমার জুনিয়র ব্যাচ ১০, ১১, ১৩ ও ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদেরও সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এসব জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে অত্যন্ত লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই দীর্ঘদিনের বঞ্চনার গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে আমাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার অনুরোধ করছি।’
বিসিএস অষ্টম ব্যাচের অবসরে যাওয়া যুগ্ম সচিব প্রিয়জ্যোতি খীসা। তিনি তাঁর আবেদনে লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ায় ভূতাপেক্ষভাবে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি চাই।’ পিএসসির মেধাতালিকায় তাঁর সিরিয়াল ১৮৪। সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ২০১৬ সালে ২৭ নভেম্বর তাঁকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। অথচ তাঁরই ব্যাচের তাঁর চেয়ে মেধায় পেছনে থাকা ১৮৫ সেলিনা আক্তার ও ১৮৬ কে এম আবদুস সালামকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে লিখিত আবেদন দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি তিনি। তাই তাঁকে ভূতাপেক্ষভাবে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিসহ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান খীসা।
চুক্তিতে কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সচিব পদে নিয়োগ চেয়ে আবেদন করেছেন অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান। ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাওয়া নবম ব্যাচের এই কর্মকর্তা আবেদনে বলেছেন, ‘সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেড-১ বা সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। নিজ ব্যাচের ৪১ জনসহ আমার জুনিয়র অন্তত ৩০০ কর্মকর্তাকে সচিব করা হলেও আমাকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে পাঁচ বছরের বেশি সময় কাজ করে আমাকে অবসরে যেতে হয়েছে। তাই আমাকে বঞ্চিত কর্মকর্তা বিবেচনায় নিয়ে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয় বিভাগে পদায়ন করতে অনুরোধ করছি।’
অবসরে যাওয়া একাদশ ব্যাচের কর্মকর্তা (উপসচিব) আবি আবদুল্লাহ তাঁর আবেদনে বলেছেন, সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও তাঁকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। তাঁর চেয়ে কম মেধাবী ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, গ্রেড-১ এবং সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাঁকে অন্যায়ভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। সুতরাং তাঁকে একসঙ্গে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতিসহ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বিসিএস ১৩ ব্যাচের পিআরএলে যাওয়া অতিরিক্ত সচিব মালেকা খায়রুন্নেছা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি চেয়ে আবেদন করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, পিএসসির মেধা তালিকায় তাঁর অবস্থান ১৫ নম্বর। তাঁর ব্যাচের কম মেধাবী পাঁচজন সচিবের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, মেধাতালিকায় ২৪তম থাকা জাহাঙ্গীর আলম, ৭৮তম থাকা নাজমুল আহসান, ৫৬তম থাকা আশরাফ উদ্দিন, ১৫১তম থাকা ওয়াহিদা আক্তার এবং ২২১তম থাকা আবদুস সবুর মণ্ডল সচিব হয়েছেন। জুনিয়র পরবর্তী ১৫তম ব্যাচের শফিউল আজিমসহ আরো তিনজনকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গত ১৭ জুলাই তিনি (আবেদনকারী) অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে আছেন। এতে তিনি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই তাঁকে ভূতাপেক্ষভাবে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে অনুরোধ জানান তিনি। এ ধরনের আরো কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
এ ছাড়া যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের ১৯৪ জন ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তা। তাঁরা এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দফায় দফায় পদোন্নতি দেওয়া হলেও তাঁদের শুধু আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি নিয়ে নানা টালবাহানা করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বিসিএস ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডারের ১৯৪ জন বঞ্চিত উপসচিব। তাঁদের সঙ্গে যাঁরা উপসচিব হয়েছিলেন তাঁরা অনেকেই যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনের বহু গ্রন্থপ্রণেতা মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘প্রশাসনের সৎ, দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি পাননি। ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তাঁদের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। অতীতেও বিএনপি আমলে বঞ্চিতদের বিবেচনা করেছে আগের সরকার। সুতরাং আওয়ামী আমলে বঞ্চিতদের ক্ষতিগ্রস্তদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।’
Leave a Reply