ভয়েজ ডেস্ক : চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের আগে সরকারের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এই টানেল দিয়ে বেশি চলাচল করবে ভারী যানবাহন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, উদ্বোধনের পর গত ১১ মাসে টানেলটি দিয়ে যেসব যানবাহন চলাচল করেছে, তার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত প্রাইভেট কারসহ হালকা যানবাহন। গণপরিবহন এই টানেল দিয়ে তেমন একটা চলাচল করছে না। সমীক্ষায় যে পরিমাণ গণপরিবহন চলাচল করবে বলা হয়েছিল, বর্তমানে তার চেয়ে তিন-চার গুণ কম গাড়ি চলাচল করছে।
এতে ব্যয় নির্বাহে যে পরিমাণ টোল আদায় হবে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, আদায় হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। বর্তমানে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হচ্ছে ১১-১২ লাখ টাকা। অন্যদিকে টোল আদায় কার্যক্রম ও টানেল রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দৈনিক ব্যয় গড়ে ৩৬-৩৭ লাখ টাকা। এতে আয়ের চেয়ে ব্যয় হচ্ছে বেশি।
গত বছর ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এই টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের মাধ্যমে চট্টগ্রামে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা, পর্যটন খাতের বিকাশ, শিল্পোন্নয়নসহ অর্থনীতির অপার দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
কিন্তু উদ্বোধনের পর গত ১১ মাসে যে সংখ্যক যানবাহন চলাচল করেছে, তা সমীক্ষার সঙ্গে কোনোভাবেই মিলছে না। এতে করে টানেল থেকে আয়ও হচ্ছে অনেক কম।
অন্যদিকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই টানেল থেকে বর্তমানে যে আয় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে টোল আদায় কার্যক্রম ও টানেল রক্ষণাবেক্ষণে। ফলে টানেল নির্মাণে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে বিপাকে পড়তে হতে পারে। এসব কারণে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে বর্তমানে চলছে নানামুখী আলোচনা।
টানেল নির্মাণে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, দূরদর্শিতার অভাব এবং অতিরিক্ত নির্মাণ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেযজ্ঞরা।
প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘টানেল চালুর পর পর্যায়ক্রমে গাড়ি চলাচল বাড়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু যে হারে গাড়ি চলাচলের কথা ছিল, বর্তমানে তার চেয়ে অনেক কম গাড়ি চলাচল করছে। আগামী দিনে যে গাড়ি চলাচল আরো বাড়বে তারও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ টানেল ঘিরে পর্যটন শহর কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপনের কথা ছিল, তা দৃশ্যমান না হওয়ায় টানেল দিয়ে গণপরিবহন তেমন চলাচল করছে না। এ ছাড়া টানেল নির্মাণে সব ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ করা হয়েছে। কিন্তু আয় হচ্ছে কম। এতে করে বিদেশি ঋণ কিভাবে পরিশোধ করা হবে—এখন প্রশ্ন সেটা। সব মিলিয়ে এই টানেলের ভবিষ্যৎ দেখছি না। এটা আমাদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘টানেল নির্মাণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওই সময় আমরা উন্নয়নবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছি। কিন্তু এই টানেল নির্মাণে দূরদর্শিতার অভাব ছিল। এই এক টানেল নির্মাণ ব্যয় দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর একাধিক সেতুসহ চট্টগ্রাম নগরকে আরো সুন্দরভাবে সাজানো যেত।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘কক্সবাজার ঘিরে বিশ্বমানের পর্যটনব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামে আবাসন, শিল্প-কারখানা, বিনোদনব্যবস্থাসহ অবকাঠামোগত যেসব উন্নয়ন প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা-ও হয়নি। এসব কারণে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল কম করছে। যেহেতু টানেল নির্মাণে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, সে কারণে কিভাবে প্রত্যাশা অনুযায়ী যানবাহন চলাচল বাড়ানো যায়, সে লক্ষ্যে এখন কাজ করতে হবে। এই টানেল নির্মাণে ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘টানেল নির্মাণের আগে গবেষণা করতে হয়। এই গবেষণা করা হয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। টানেলে যানবাহন চলাচল বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ও শিল্প-কারখানা স্থাপন। কিন্তু এসব কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।’
বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগর চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন হয় গত বছর ২৮ অক্টোবর। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেল নির্মাণ করা হয়। টানেলের দুই প্রান্তে (নগর ও আনোয়ারা অংশ) রয়েছে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও উড়ালসেতু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যানুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে এই টানেল দিয়ে দৈনিক ১৭ হাজার ২৬০টি যানবাহন চলাচল করতে পারবে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৫ সালের পর থেকে টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি। টানেলের লাইফটাইম ১০০ বছর। কর্ণফুলী নদীর এক পারে বন্দরনগর চট্টগ্রাম, অন্য পানে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলা।
গত বছর ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পর ২৯ অক্টোবর থেকে টানেলে যান চলাচল শুরু হয়। শুরুতে এতে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। পরে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হয়। এর মধ্যে ছয় হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে।
৩-৪ গুণ কম গাড়ি চলাচল করছে
সমীক্ষা অনুযায়ী, এই টানেল চালুর পর প্রথম পর্যায়ে দৈনিক ১৭ হাজার ২৬০টি যানবাহন চলাচল করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। উদ্বোধনের পরের মাস গত বছরর নভেম্বরে টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩১২টি। অর্থাৎ ওই মাসে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে পাঁচ হাজার ৫৪৪টি। এতে আয় হয়েছে তিন কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ টাকা। এই হিসাবে ওই মাসে প্রতিদিন আয় হয়েছে ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৩ টাকা। এরপর ডিসেম্বরে গাড়ি চলেছে এক লাখ ৯৩ হাজার ৪২১টি। অর্থাৎ প্রতিদিন চলেছে ছয় হাজার ২৩৯টি। এদিকে চলতি বছর এপ্রিল মাসে গাড়ি চলাচল করেছে এক লাখ ১৫ হাজার ৬৪৮টি। এই হিসাবে দৈনিক গাড়ি চলেছে তিন হাজার ৮৫৫টি।
র্বশেষ চলতি সেপ্টেম্বরের ১ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ২১ দিনে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ৬৪ হাজার ৫৪৯টি। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে তিন হাজার ৭৩টি। এই হিসাবে গত প্রায় ১১ মাসে টানেল দিয়ে প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করেছে চার-পাঁচ হাজারটি।
টোল আদায় হার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের বর্তমান টোল আদায় হার : কার, জিপ ও পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ আসন বা এর কম) ৩০০ টাকা, বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) ৪০০ টাকা, বাস (৩-এক্সেল) ৫০০ টাকা, ট্রাক (পাঁচ টন পর্যন্ত) ৪০০ টাকা, ট্রাক (৫.০১ টন থেকে আট টন পর্যন্ত) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৮.০১ টন থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ৬০০ টাকা, ট্রাক/ট্রেইলার (তিন এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রাক/ট্রেইলার (চার এক্সেল) এক হাজার টাকা, ট্রাক/ট্রেইলার (চার এক্সেলের বেশি) এক হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেল বাবদ ২০০ টাকা যোগ হবে।
আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি
হিসাব অনুযায়ী টানেল থেকে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হচ্ছে ১১-১২ লাখ টাকা। অন্যদিকে টোল আদায় কার্যক্রম ও টানেল রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে ব্যয় গড়ে ৩৬-৩৭ লাখ টাকা। তবে এই ব্যয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে রাজি হননি।
চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ কিভাবে?
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর থেকে টানেলের জন্য নেওয়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার কথা। কিন্তু এই টানেল থেকে আয় কম হওয়ায় ঋণ পরিশোধে সরকারকে রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকি দিতে হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সরকার কাজ করছে।
টানেল নির্মাণ ব্যয় বেশি
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে চীনের দীর্ঘতম হাইওয়ে টানেল টাইহুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেলটি চালু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ভারতের মুম্বাইয়ে মুম্বাই কোস্টাল রোড প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রের তলদেশে দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় এক হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা।
আর বাংলাদেশে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের মোট ব্যয় প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি।
Leave a Reply